জুলাইয়ের দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগীর আশঙ্কা আগস্টে
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এখন নিয়ন্ত্রণহীন। এডিস মশা নিধনে নেই কার্যকর উদ্যোগ। শহর থেকে গ্রাম সবখানে ডেঙ্গুর বিস্তার। লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সূচক। গতকাল বৃহস্পতিবার চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৫৯ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত জুলাইয়ে ৪৪ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। মশক নিধনে ব্যর্থতার কারণে চলতি মাসে এডিস মশার প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার এ দেশে দুই দশকের বেশি সময় ধরে। ২৩ বছরের ইতিহাসে এ বছর সর্বোচ্চ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ১ লাখ ১ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। জুলাই ও আগস্টেই ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি রোগী ভর্তির শঙ্কা রয়েছে। গত ১০ দিনে ২৬ হাজার ১৯৬ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে আরও ১১৩ জনের। গত এক সপ্তাহ ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে দ্বিগুণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। অতীতেও জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি লক্ষ করা গেছে। জনস্বাস্থ্যবিদরাও একই বিষয়ের আশঙ্কা করছেন। তারা বলছেন, মশক নিধনে কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ নেই। ফলে ডেঙ্গুর বিস্তারও নিয়ন্ত্রণহীন। শুধু আগস্ট নয়—এই ভয়াবহতা আগামী নভেম্বর পর্যন্ত থাকতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বিষয়টি অস্বীকার করেনি। সর্বশেষ ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, আগস্টেও ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মশক নিধনের মাধ্যমে যদি আক্রান্তের হার কমিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে আগস্টে আক্রান্তের হার বেশি হতে পারে।
এদিকে গতকাল মৌসুমে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ১২ জনের। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬৪-এ। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৯ হাজার ৭৯০ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। ঢাকার বাইরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ৪৬০ জন। অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার ৩৩০ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অতীতের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা গেছে। আগস্টের গত ১০ দিনে ২৬ হাজার ১৯৬ রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১১৩ জনের। চলতি বছরের জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪ ডেঙ্গু রোগী সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় মৃত্যু হয় ২০৪ জনের। অন্যান্য মাসের হিসাবে দেখা গেছে, জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। মৃত্যু হয় ছয়জনের। ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন আক্রান্ত হন। তার মধ্যে মৃত্যু হয় তিনজনের। মার্চে মৃত্যু হয়নি। তখন ১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এপ্রিলে ১৪৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। তার মধ্যে মৃত্যু হয় দুজনের। মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। তার মধ্যে দুজনের মৃত্যু হয়। আর জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। মৃত্যু হয় ৩৪ জনের।
এর আগের বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ৬১ হাজার ৭৬৩ জন। এ সময়ে মৃত্যু হয় ২৮১ জনের। ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ৫৭১ জন। এ সময় মৃত্যু হয় ৯ জনের। জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছিল।
এর আগের বছর ২৮ হাজার ৪২৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় মৃত্যু হয় ১০৫ জনের। ২১ সালের জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ রোগী ভর্তি হন। মারা যান ১২ জন। আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৮ রোগী ভর্তি হন। তখন মৃত্যু হয় ৩৪ জনের।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ডেঙ্গুর পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই বছর ডেঙ্গুর প্রকোপও তেমন দেখা যায়নি। সরকারি তথ্যমতে, সে বছর মাত্র ১ হাজার ৪০৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এর আগে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন ২০১৯ সালে। সে বছর ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ ডেঙ্গু রোগী রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ও শায়ত্ত্বশাসিত হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় ডেঙ্গু সন্দেহে ২৬৬ জনের মৃত্যুর তথ্য আসে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে। সেখান থেকে ২৬৩ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৬৪ জনের ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিশ্চিত করে আইইডিসিআর।
বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লষণ করে দেখা গেছে, আগস্টে জুলাইয়ের দ্বিগুণ রোগী ভর্তির শঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও আশঙ্কা করছে। গত বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমআইএস ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, যেহেতু ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ছে, আগস্টেও ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী। জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মশক নিধনের মাধ্যমে আক্রান্তের হার যদি কমিয়ে আনতে না পারি, তাহলে এই আগস্টেই আক্রান্তের হার বেশি হতে পারে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে ক্ষেত্রগুলো রয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সব ব্যবস্থাপনা, অন্যান্য সরঞ্জাম—এ বিষয়গুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছি।
ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু এখন মহামারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত কয়েক বছরের ডেঙ্গুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আগস্টে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয় সবচেয় বেশি। ২০২২ সালের তথ্য বলছে, এখন শুধু আগস্ট নয়, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এ বছরও বর্ষা মৌসুম বিলম্বে এসেছে। সে হিসবে ধারণা করা যাচ্ছে, জুলাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি রোগী আগস্টে আক্রান্ত হতে পারে। মশক নিধনে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া না হলে আগামী তিন মাস (আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) ভয়াবহতা ছড়াবে।
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।