তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প
তুরস্কের আনাতোলিয়ায় যে ভূগর্ভস্থ চ্যুতি বা ফল্ট রয়েছে সেখান থেকে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ওই ফল্ট বেশ সক্রিয়। সেখান থেকে এ ধরনের শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন। তবে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি। ভবন বানানোর সময় যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে চলা, সর্বোপরি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয় কী সেসব জানা জরুরি।
তুরস্কের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টের অবস্থান অ্যারাবিয়ান প্লেট ও আনাতোলিয়ান প্লেটের মাঝে। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে বহু আগে থেকেই খুবই বিপজ্জনক উল্লেখ করে সতর্ক করেছিলেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা। ৬ ফেব্রুয়ারির ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্কের প্রায় ১০০ কিলোমিটার ফল্টলাইন ভেঙে গেছে। এ কারণেই সৃষ্ট ভূমিকম্পটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আর এই ফল্টের কাছাকাছি থাকা ভবনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
প্রায় ৮৪ বছর পর তুরস্কে আবারও ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূকম্পনবিদ স্টিফেন হিকস বলেন, এর আগে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। ছয় ফেব্রুয়ারি,২০২৩ তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পকে এই দশকের সবচেয়ে প্রাণঘাতী হিসেবে মনে করা হচ্ছে। ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
ভেঙে পড়েছে ৬ হাজারের বেশি ভবন। কী কারণে এতো ভয়াবহ ছিল এই ভূমিকম্প তা নিয়ে আলোচনাও চলছে। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল তুর্কি শহর নুরদাগি থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বের পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টের ১৮ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পটির শক্তিশালী কম্পনগুলো উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে মধ্য-তুরস্ক এবং সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, এই অঞ্চলে ১৯৭০ সালের পর থেকে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ওপরে মাত্র তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে।
তবে ১৮২২ সালে একটি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে আনুমানিক ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। যেকোনো বছরে ৭ মাত্রার বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয় গড়ে ২০টিরও কম। সেই হিসেবে তুরষ্কে আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ছিল অনেক বেশি প্রাণঘাতী।
২০১৬ সালে ইতালির মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল যাতে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই তুলনায় আজ তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পটি ছিল ২৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে এতবেশি শক্তির ভূমিকম্প হয়েছিল মাত্র ২ বার। পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে একটি স্ট্রাইক-সিøপ ফল্ট হিসেবে মনে করা হয়। এই ফল্টে কঠিন শিলাযুক্ত প্লেটগুলো ফল্টলাইন জুড়ে উল্লম্বভাবে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়।
শিলাযুক্ত প্লেট যতক্ষণ পর্যন্ত আনুভূমিক গতিতে পিছলে না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের মাঝে ঘর্ষণ চলতে থাকে। ফলে প্রবল বেগে সেখান থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়Ñ যা ভূমিকম্পের সূত্রপাত ঘটায়। তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভূমিকম্পের প্রাথমিক ফাটলটি ভূপৃষ্ঠের তুলনামূলক অগভীর অবস্থানে উৎপত্তি হয়েছে। ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূ-বিজ্ঞানী ডেভিড রথারি বলেন, উৎসের গভীরতা কম হলে ভূমিকম্পে ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন বেশি তীব্র হয়।
প্রাথমিক ভূমিকম্পের এগারো মিনিটের মাথায় তুরস্ক-সিরিয়ায় ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আফটার শক অনুভূত হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর আবারো ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। পরে বিকেলের দিকে আবারও ৬ মাত্রার আফটার শক অনুভূত হয়। এর আগে ১৮২২ সালের ভয়াবহ প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পরের বছরও দেশটিতে আফটার শক অব্যাহত ছিল। এর আগে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ৯ হাজার মানুষ মারা যায়।
বিশ্বে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা শহরগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকা অন্যতম। আর্থ অবজারভেশন সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমারÑ এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। যার ফলে এ অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ঘনবসতিপূর্ণ শহরটির ঝুঁকি কমাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিবারই বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার পর ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়, যা ধামাচাপা পড়ে বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আক্তার বলেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সবশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিÑসিডিএমপি ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপ।
ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভূমিকম্পে দুর্যোগের ঝুঁকিও। বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভারত প্লেট, উত্তরে তিব্বত উপপ্লেট এবং পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে বার্মা উপপ্লেট। ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। পূর্ব অংশটি বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমাংশ ভারতীয় প্লেটের অন্তর্গত। শিলং মালভূমি ভারত প্লেটের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি প্লেট। এটি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। ভূতাত্ত্বিক গঠন ও টেকটোনিক কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা।
বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশের ভূতাত্ত্বিক ও টেকটোনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, সুদূর ও নিকট অতীতে এ অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও পার্শ্ববর্তী এলাকার (উত্তর ও পূর্ব দিকে) ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি রয়েছে। পূর্বাংশের পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকসন জোন, যেখানে ভারতীয় প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণে এসব ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি ও সাবডাকশন জোনে বিপুল শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। গত ৪০০ বছরে সাবডাকশন জোন ও চ্যুতিগুলো থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর গতিপথের পরিবর্তন হয়েছে। সাবডাকশন জোন থেকে সংঘটিত ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়ংকর। একই মাত্রার ভূমিকম্প বর্তমানে রাজধানী ঢাকা বা এর আশপাশে হলে কী ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা কল্পনা করলেও আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। কারণ, ঢাকা শহরে কেবল পুরনো নয়, অতি পুরনো অনেক ভবনও রয়েছে এবং সেসব ভবনে ঝুঁকি নিয়েই অনেক মানুষ বসবাস করছেন। কাজেই একই মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী হবে, তা ভেবে দেখার সময় এখনই। ফলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও গবেষক
raihan567@yahoo.com
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।