নিউজ ডেক্স
আরও খবর
১৫ লাখের ছাগল বৃত্তান্ত !
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক সিনেমা
এমপি খুন, নিষ্ঠুর সমাজ, মানিক সুনীলের ভালোবাসা
‘ঈদ যাত্রায় ভোগান্তি’ ও ‘বাড়ি’ ফেরার ঈদ আনন্দ
ভারতের ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন ও বাংলাদেশের বিভ্রান্ত বিরোধী দল
ভারতের গণতন্ত্র কি সঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ?
‘দলীয় সাংবাদিক’ ও সাংবাদিকতায় অনাস্থা
নাজনীন মুন্নীঃ
এই সময়ের একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘যেসব সাংবাদিক দলীয় হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, তারা সাংবাদিকতা ছাড়ুন।’ খুবই যৌক্তিক দাবি। তারা সাংবাদিকতা ছাড়লেই সাংবাদিকতা একটা আস্থার জায়গায় আসে। কিন্তু তার এ দাবি নিয়ে তিনি ৫ ঘণ্টাও টিকে থাকতে পারেননি। কারণ, এ দাবি শতকরা ৮০ ভাগ সাংবাদিকের হলেও শতকরা ২০ ভাগ এত ক্ষমতাশালী যে তাদের বিপরীতে টিকে থাকা কঠিন। তিনি পারেননি, আমরাও পারিনি। ফলে, সবাইকে নিয়ে সাংবাদিকতা নামের টাইটানিক দুই ভাগ হয়ে ডুবে যাচ্ছে। এক ভাগের নাম ‘আওয়ামী সাংবাদিক’, আরেক ভাগ ‘বিএনপি’র।
মানুষ গণমাধ্যমের ওপর দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বের ৪৬টি দেশের ওপর রয়টার্স এক জরিপ করেছে। ওই বার্ষিক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিন জনের ধারণা, গণমাধ্যমগুলো সমাজের চেয়ে তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থকে এগিয়ে রাখছে। এতে ১০ জনের মধ্যে ৩ জনের অভিযোগ, তারা যেসব সংবাদ দেখেন তা পক্ষপাতদুষ্ট। এছাড়া, শতকরা ১৬ ভাগ মানুষ মনে করেন, প্রচারিত খবরের তথ্য তাদের কোনও কাজে আসে না।
তিন জনের অভিযোগ কিন্তু আমাদের দেশের না, আমাদের দেশে সংখ্যাটা ১০ জনেরও বেশি হবে নিশ্চিত। এ আস্থার জরিপে আমাদের অবস্থান ১৬৫ নম্বরে। আমাদের আগে ভারত, পাকিস্তানসহ আরও ১৬৪টি দেশ আছে। পক্ষপাতদুষ্ট শব্দটা আমাদের জন্য বোধকরি বেশি প্রযোজ্য। একটা সময় ছিল, যখন কোনও সাংবাদিক তার রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা মত প্রকাশ করতো না। করলেই তিনি বা তারা গ্রহণযোগ্যতা হারাতেন। কারণ, মনেই করা হতো, তিনি যা বলছেন তা নির্দিষ্ট একটি দলের ভালোর জন্যই বলেছেন, তাতে সত্যতা নাও থাকতে পারে।
এখন সবাই তার পরিচয় আড়াল করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না, বরং এক ধরনের গর্ববোধের অবস্থা দেখতে পাই। অনেকেই প্রমাণে ব্যস্ত তার রাজনৈতিক মত, কিংবা পরিচয় তুলে ধরতে। তারা সরাসরি বলতে চান আমরা বিশেষ ‘দলের সাংবাদিক’। মানুষের অনাস্থা আর সন্দেহের শুরু মূলত এখান থেকেই।
সাংবাদিকদের বলা হয় কলম সৈনিক। কলমটা তার অস্ত্র এবং সেটা দিয়েই প্রতিনিয়ত তার যুদ্ধ। সশস্ত্র বাহিনী যেমন কোনও বিশেষ দলের না, দেশের জন্য লড়াই করে, দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। সাংবাদিকরাও একেকজন যোদ্ধা, তাদের হওয়ার কথা দেশের, নির্দিষ্ট কোনও দলের নয়। কিন্তু আমরা দলীয় হয়েছি, হয়ে পড়ছি।
‘আমরা’ শব্দটা বললে সবার প্রতি অবিচার করা হয়। বলা হয়ে থাকে কিছু সংখ্যক সাংবাদিক এবং এই সাংবাদিকরা সর্বোচ্চ পদে থাকায়, তাদের চেহারাটাই সবসময় দেখা যায়। এসব কারণেই জনমনে ধারণা হয় যে সাংবাদিক মানেই দলীয়।
বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রে উল্টো। যাদের চেহারা দেখা যায় তাদের অনেকেই মালিক। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবেন, এটি স্বাভাবিক, অস্বাভাবিকের কিছু নেই। অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ তার কর্মী বাহিনীকে সেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যবহার করবেন সেটিও স্বাভাবিক। বিষয়টা হচ্ছে, মালিকরা কিন্তু সবাইকে ব্যবহার করেন না। কিন্তু অনেকেই আছেন, যারা নিজ থেকেই ব্যবহৃত হতে চান। সমস্যা মূলত তাদের নিয়েই।
তারা এত উচ্চকণ্ঠ আর প্রকাশ্য যে জনগণ মনে করেন এরাই সাংবাদিক এবং সাংবাদিক মানেই দলীয়। কিন্তু তারা এসব করে দল বা দেশের জন্য এমন নয়, তারা সবাই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই এসব করেন। এমন ‘দলীয় সাংবাদিক’ পাবেন না, যিনি পদ-পদবি কিংবা অর্থ উপার্জন করে রমরমা অবস্থায় নেই।
তারা না থাকলে দলের কিছুই হয় না। দলকে টিকিয়ে রাখে মূলত কর্মী বাহিনী। রাজনৈতিক দলগুলো টিকে থাকে জনগণের ভালোবাসায়।
‘রাজনৈতিক দলগুলোকে টিকিয়ে রাখে সাংবাদিকরা’, এই ধারণা ভুল। তারা বড়জোর কিছুটা সহায়ক হিসেবে কাজ করেন, যেমন- পুলিশ কিংবা প্রশাসন। সাংবাদিকতা দিয়ে সরকার গঠন করা গেছে বা ফেলে দেওয়া গেছে, এই দেশের ইতিহাসে নেই। তবু এই বিশেষ শ্রেণির সাংবাদিকরা এমন ভাব করতে থাকেন যে সরকার টিকে আছে কেবল তাদের জোরে।
একজন সাংবাদিক ভালো কাজে সরকারের প্রশংসা করবেন, খারাপ যা তা তুলে ধরবেন, সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু আপনি যদি দেখেন বছরের পর বছর খারাপ কাজটির পক্ষেও তার যুক্তি থাকে কোনও বিশেষ দলের পক্ষে, তখন বুঝে নিতে হবে তিনি আসলে সেই দলীয় সৈনিকই। এই সৈনিক দলের জন্য যত না করেন, তার চেয়ে বেশি করেন নিজের জন্য। তারা তোষামোদির বিনিময়ে কোটি টাকার কাজ, বিদেশ ভ্রমণ, বড় পদ আর ক্ষমতা সব নেন।
তাহলে কেমন করে বলবেন যে সেই সাংবাদিক নিঃস্বার্থভাবে দলকে বা আদর্শকে ভালোবেসেই সেই দলের পক্ষে কথা বলেন? বলা হয়ে থাকে, যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হতো স্বাভাবিক নিয়মে, তবে বেশিরভাগই এমন দলীয় রূপে প্রকাশ্য হতেন না। তারা সাংবাদিক থাকারই চেষ্টা করতেন।
এখন যেটা হয়েছে, আমরা সবাই জনসংযোগ কর্মকর্তার কাজ করছি। এই মন্ত্রী কী বলছেন, আওয়ামী লীগ কী বলে, বিএনপি কী বলে, অন্যরা কী বলে, তাতেই আমাদের সাংবাদিকতা আটকে গেছে। তবু এর মধ্যেই অনেকে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন। তা না হলে এত অপরাধের খবর আপনারা কোথায় পেতেন? সেটা সাংবাদিকরাই বের করেন। তারাই আসল সাংবাদিক।
তো এমন সব সাংবাদিকদের জনগণ চেনেন। তবু ঢালাওভাবে সবার ওপরই অনাস্থা তৈরি হয়েছে। একসময় সাংবাদিকদের যে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো, এখন অহরহ মিলছে কটু কথা।
সাংবাদিকরা, যারা ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ লাভজনক অবস্থায় আছেন, তারা সাংবাদিকতা কোথায় গেলো সেসব নিয়ে মাথা ঘামান না। কারণ, সাংবাদিকতা তাদের কেবল ‘নেইমপ্লেট’। কিন্তু যারা আসলেই সাংবাদিক তারা প্রতি মুহূর্তে বোধ করেন সাংবাদিকতা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট, সম্মান আর আস্থা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা। ধ্বংসস্তূপে বসে থেকে তারা আবার জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখেন। এমন সাংবাদিকতার স্বপ্ন দেখেন, যা শুধুই কথা বলবে দেশ আর জনগণের।
লেখক: সাংবাদিক
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।