পহেলা বৈশাখ ও বাঙালিত্বে মুসলমানের শরিকানা – দৈনিক গণঅধিকার

পহেলা বৈশাখ ও বাঙালিত্বে মুসলমানের শরিকানা

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ১২ এপ্রিল, ২০২৩ | ১০:১১
গাড়ির জ্বালানি তেল-গ্যাস; বাঙালির জ্বালানি হলো বিতর্ক। আমরা বিতর্কচালিত জাতি। ইস্যু মাঠে পড়ামাত্রই এই জাতি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে বিতর্কে নেমে পড়ে। তারপর সেটাকে কাজিয়া বানিয়ে ফেলে। এই কাজিয়ায় ‘অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া’ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। বর্তমানে বঙ্গবাজারের আগুন না; দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি না; আসন্ন রাজনৈতিক কালবৈশাখী না– ফেসবুক-বাঙালিরা মজে আছেন পহেলা বৈশাখ উদযাপন বিতর্কে। এখানে মোটাদাগে দুটি পক্ষ থাকলেও, কর্মসূচিতে তারা এক। উভয়েই চায় প্রতিপক্ষকে নিষিদ্ধ করতে। অথচ নিষিদ্ধতাবাদ দিয়ে পাকিস্তান টেকেনি। জনগোষ্ঠীর আবেগকে আহত করা প্রগতিবাদও বুমেরাং হতে বাধ্য। কেউ কেউ বলে থাকেন, বাংলা নববর্ষ হিন্দুয়ানি কালচার। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে যে জনস্রোত বের হয়, তার ভেতর সনাতন ধর্মীয় সংস্কৃতির অনেক উপাদানই নাকি হাজির। বোঝানো হচ্ছে, বাঙালি সংস্কৃতি মানেই যেন হিন্দুয়ানি ব্যাপার। ইসলামের ধর্মীয় জায়গা থেকে এতে কারও আপত্তি থাকতে পারে। যাঁর আপত্তি তিনি যাবেন না। কিন্তু উৎসব নিষিদ্ধ করার জন্য উকিল নোটিশ পাঠানো কেমন কথা? যে আইনজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের জন্য নোটিশ এলান করেছেন; তিনি ভালো করেই জানেন– এই নোটিশ আদালতে পাত্তা পাবে না। তারপরও তিনি সফল। তাঁর নাম ফেটেছে। জাতীয় জীবনের জ্বলন্ত প্রশ্ন থেকে চোখ সরানো গেছে। এহেন নোটিশ পাঠানো কোনো নিরীহ ব্যাপার না হয়তো। সংস্কৃতির মামলার মীমাংসা আদালত করতে পারেন না। এটা সমাজের বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন খোলাসা করে নেওয়া ভালো। প্রথমত, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কোনো ধর্মেরই বিরোধ নেই। বাঙালি সংস্কৃতি একধর্মীয় ব্যাপার না। বাংলাদেশ বহু সংস্কৃতির মিলনের এক মোহনা। এখানে আরব-ইরানি-তুর্কি-আফগানরা এসেছে। অগ্নি উপাসক আর্যরা এসেছে। সর্বপ্রাণবাদী লোকধর্মের মানুষ এখানে ছিল। বৌদ্ধরা ছিল বিপুল মাত্রায়। ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরাও প্রভাব ফেলে গেছে। সব মিলিয়েই বাংলাদেশ। সবারই শরিকানা আছে এই দেশ, এই ভাষা ও সংস্কৃতিতে। বাংলা সন কী করে হিন্দুয়ানি হবে? বৈদিক নববর্ষ বৈশাখে শুরু হতো না। তা হতো অগ্রহায়ণ মাসে। বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস ধরে সন গণনার নিয়ম চালু করেন মুঘল সম্রাট আকবর; কর আদায়ের সুবিধার জন্য। ভারতীয় শকাব্দ ও আরবি হিজরি মাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে মিলিয়ে তিনি এই ক্যালেন্ডার চালু করেন। এ কাজের ভার দিয়েছিলেন সেকালের বিশিষ্ট ইরানি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজির ওপর। হিজরি চান্দ্রবর্ষপঞ্জিকে ভারতীয় সৌরবর্ষপঞ্জিকার সঙ্গে মেলান শিরাজি। বাংলা সন ও হিজরি সন এ জন্যই ঘনিষ্ঠ থাকে। পূজা-পার্বণের তারিখও ইসলামের মহানবীর হিজরত আর মুঘল বাদশাহ আকবরের অভিষেকের ইতিহাসের সঙ্গে আংকিকভাবে জড়িত। হিসাবটা হয় এভাবে: সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের হিজরি সন (৯৬৩) + বর্তমান গ্রেগরিয়ান সন (২০২৩) – আকবরের সিংহাসন পাওয়ার গ্রেগরিয়ান সন (১৫৫৬) = বাংলা বর্তমান সন ১৪৩০। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো মহল বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূমিকে যথেষ্ট ইসলামী মনে করছেন না। অথচ এই তিনটি জিনিসে মুসলমানদের অবদান কারও চাইতে কম না। সেন রাজাদের আমলে রাজদরবারে ও ধর্মচর্চায় বাংলাকে দূর দূর করা হতো। এটা সেই যুগের কথা যখন ব্রাহ্মণরা প্রচার করতেন– যারা ১৮টি পুরাণগ্রন্থ ও রামায়ণ বাংলা ভাষায় শুনবে, তারা রৌরব নরকে গমন করবে। চালু হয় এই অভিশাপ, ‘কৃত্তিবেশে কাশীদেশে আর বামুন ঘেঁষে– এই তিন সর্বনেশে’ (কৃত্তিবাস, কাশীদাস হিন্দু পুরাণ বাংলায় অনুবাদ করে পাপ করেছেন এবং যারা বামুনদের সঙ্গে মিশে তাদের সমান হতে চায়, তারাও সর্বনাশা।) মুসলমান সুলতানেরাই রামায়ণ, মহাভারতসহ অনেক দেশীয় সাহিত্য ও শাস্ত্রের অনুবাদ করিয়ে নেন বাংলায়। বাদশাহর দেখাদেখি ছোট রাজা ও জমিদাররাও বাংলার কদর করতে থাকেন। রামায়ণের অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা, মহাভারতের অনুবাদক কাশীরাম দাস, কবি বিদ্যাপতি, মালাধর বসু, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্রের লেখনী সাক্ষ্য দেয়– মুসলমান শাসকরাই ছিলেন তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেন লিখছেন, ‘হুসেন শাহ এবং অপরাপর মুসলমান সম্রাটেরা দেশীয় ভাষায় কতটা অনুরাগী ছিলেন, তাহার প্রমাণ প্রাচীন বঙ্গ-সাহিত্যের অনেক স্থানেই পাওয়া যায়...মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলা ভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতনভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।’ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁরা কারা? বাঙালির বড় অংশই তো মুসলমান। তাঁরাই এই ভাষাকে কলমে ও কথায় টিকিয়ে রাখছেন। মূলত কৃষক সংস্কৃতিই জাতীয় সংস্কৃতি। সেই কোটি কোটি কৃষককে বাদ দিয়ে কোনো সংস্কৃতি কি কল্পনা করা সম্ভব? তাই যাঁরা মুসলমানদের তাদের ভাব ও ভাষার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে চান; নানান কিছু নিষিদ্ধ করতে চান; তাঁরা আর যা-ই হোন; মুসলমানের বন্ধু নন। এদের দেখেই ফকির লালন শাহ বলেছিলেন– ‘থাকতে রতন ঘরে, এ কী বেহাত আজ আমারি’। সংস্কৃতি নিয়ে আতংক কোনো সুস্থ ব্যাপার না। মানুষের শরীরে যেমন হাড়ের ওপর মাংসের ছাউনি থাকে; চামড়ার আবরণ থাকে; সংস্কৃতি তেমনি আমাদের জীবনের আবরণ। এই আবরণ খসিয়ে ফেললে আমরা আরও অরক্ষিত হই; নগ্ন হই। আমাদের জীবন ও অর্থনীতির হাড়ের কাঠামোটা তখন অনিরাপদ হয়ে ওঠে। শবেবরাত কিংবা পহেলা বৈশাখ নিয়ে এই বিতর্ক তাই আত্মঘাতী। পহেলা বৈশাখের এই দিগ্‌বিজয় বাংলাদেশে যত; পশ্চিমবঙ্গে ততটা নয়। পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘বেহালখাতা খোলার দিন’ শিরোনামে শিশির রায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, “পড়শি রাষ্ট্র যখন পয়লা বৈশাখ দিনটাকে রীতিমতো ঢুকিয়ে নিয়েছে হৃদয়ে-রক্তে, বৈশাখী উৎসবকে রূপ দিয়েছে একটা জাতিসত্তার ‘কার্নিভাল’-এ, গঙ্গার এপারে আমরা তখন হুজুগে বাঙালিয়ানার দেখনদারির মোচ্ছবে আকুল।” অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের বর্তমান রূপটা খাঁটি বাংলাদেশি জিনিস। এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ঐতিহ্যেরই ছাপ আছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের নববর্ষও প্রায় একই সময়ে হওয়ায় পহেলা বৈশাখ সত্যিকারভাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠার যোগ্য। একে তাই সাম্প্রদায়িক-অসাম্প্রদায়িকের আলাপের বাইরে আনা দরকার। পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রাকে রাজনীতি এবং ঘৃণা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করাও উচিত না। বাঙালি মুসলমান আমজনতা এই উৎসবকে নিজের করে দেখিয়ে দিয়েছে– তারা মুসলমানও বটে, বাঙালিও বটে। প্রথমটা তার সম্প্রদায়, দ্বিতীয়টা তার জাতি-পরিচয়। তবে তাদের বাঙালিত্বটা আরেকটু সরেস ও গণমুখী। চিন্তাবিদ বিনয় সরকারের কথা ধার করে একে বলতে চাইছি ‘বাঙলামি’। রমনা বটমূলের গম্ভীর অনুষ্ঠানটা কিন্তু সারাদেশ অনুকরণ করেনি। কারণ ওর ভাবগাম্ভীর্য ও ভারিক্কিপনা। তুলনায় চারুকলার অনুষ্ঠানটা ছিল সহজ ও বহনযোগ্য। অর্থাৎ যে কেউ নিজ নিজ এলাকায় এ রকম উৎসব, মেলা চালু করতে পারে। করছেও। হিন্দি ও ইংরেজির দাপট থেকে বাঁচতেও কাজে লাগছে এই বাঙলামি। সেই কাজেই বর্ষবিদায়ের চৈত্রসংক্রান্তি আর বরণের পহেলা বৈশাখ মিলে গিয়ে এক উৎসব হওয়াই ভালো। রাষ্ট্র বাঙালিত্বের জন্ম দেয়নি, বরং বাঙালিত্বই রাষ্ট্রকে পয়দা করেছে। বাঙলামি প্রসারের ধর্মপিতাও রাষ্ট্র নয়। সব সমালোচনা সত্ত্বেও এই উৎসবের জন্ম সমাজের হাতে; তরুণদের উদ্যমে। বৈশাখের এই এক থেকে বহু হয়ে ছড়িয়ে পড়া নতুন ঘটনা। এ ঘটনা ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজেরই অবদান। ঢাকাই মধ্যবিত্ত শত অসংগতি সত্ত্বেও নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টির ক্ষমতা যে ফুরিয়ে ফেলেনি, এটাই নতুন সংবাদ। কিন্তু এই সক্ষমতাকে মাটির আরও কাছে, মানুষের আরও ঘনিষ্ঠ হতে হবে। এর গা থেকে সাম্প্রদায়িক ভেদচিহ্ন সরাতে হবে। কোনো সম্প্রদায়কে ‘অপর’ করে দেওয়া মোটেই সুবুদ্ধির পরিচয় না। এটাই একমাত্র দিন, যেখানে সব ধর্মের বাঙালিরা এক উৎসবে শামিল হতে পারে। আগে পশ্চিমবাংলা থেকে সাংস্কৃতিক ঢেউ আসত। এখন বাংলাদেশ থেকে ওঠা সাংস্কৃতিক তরঙ্গ সারাবিশ্বের বাঙালিদের আলোড়িত করে। জাতিবাদী ও ধর্মবাদীরা যেন এর সম্ভাবনাটা বুঝতে পারেন। জাতিবাদ ও ধর্মবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ির ফল ভালো হয় না। যদি সাম্প্রদায়িকতা থেকে থাকে, তা দু’পক্ষেই আছে। এক হাতে সাম্প্রদায়িকতার তালি কখনও বাজে না।

দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ট্যাগ:

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:


শীর্ষ সংবাদ:
পার্বত্য চট্টগ্রামে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো নির্দেশনা নেই বিচার বিভাগ থেকে যেন কোনো অবিচার না হয় : আইন উপদেষ্টা গার্মেন্টস খাতে অস্থিতিশীলতায় প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন: শ্রম সচিব হত্যাকারীদের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে রেখে ভালো কিছু সম্ভব না: মির্জা ফখরুল চাটমোহরে ছাত্রদল নেতা গুলিবিদ্ধ, কাটা হয়েছে পায়ের রগ দেশ গঠনের বার্তা দেবেন তারেক রহমান পিতাপুত্রের টাকা পাচার যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে: মুজিবুর রহমান বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সরকারি কলেজের দাপুটে শিক্ষক মহোদয়দের অনৈতিক কার্যকলাপ কুমারখালীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলোনে শহীদদের স্বরণে নাগরিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত। ত্রাণ নিয়ে মানুষ ছুটছে টিএসসিতে ভারতের বাঁধ ভাঙা পানিতে ডুবছে গ্রামের পর গ্রাম বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ–ভারতের নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব: প্রধান উপদেষ্টার ২১ দশমিক ৬ শতাংশ টাওয়ার অচল চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনা মোতায়েন এখন পর্যন্ত ৩৬ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত বন্যায় ভয়াবহ বিপর্যস্ত ১২ জেলা, মৃত্যু ৮ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের রিট শুনানি ঘিরে সারাদেশে সতর্ক পুলিশ তাহিরপুর বিভিন্ন ছড়া ও নদীর খনিজ বালু হরিলুট,যেন দেখার কেউ নেই