নিউজ ডেক্স
আরও খবর
ভারতের গণতন্ত্র কি সঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ?
এম আর ইসলাম
ভারতের নির্বাচন শুধু ভারত রাষ্ট্র বা তার জনগণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের জন্য এই নির্বাচন প্রভাব ফেলে। আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনকালে পৃথিবীর তাবৎ অঞ্চলের মানুষ ওই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যেমন উদ্বিগ্ন থাকে, তেমনি ভারতের নির্বাচনের ফলাফল দক্ষিণ এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনীতিসহ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সীমানা-নিরাপত্তা, সংখ্যালঘুদের অধিকার ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণে ভারতের নির্বাচনের ফলাফলের ভূমিকা রয়েছে বরাবরই।
নিঃসন্দেহে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। এত বড় ভূখণ্ড, এত প্রদেশ, এত রকমের ধর্ম-বর্ণ-ভাষাভাষীদের নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটা দেশ যে ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে তাদের গণতান্ত্রিক যাত্রা ধরে রাখতে পেরেছে, তার কৃতিত্ব ভারতের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ও সাধারণ ভোটারদের। তবে, ভারতে যে সবসময় উৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের চাষ হয়েছে তা বলা যায় না। তবে ভারতীয় কংগ্রেসের উদার রাজনীতিক, যেমন: মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, বি আর আম্বেদকার, মাওলানা আবুল কালাম, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলসহ অন্যান্য নেতার হাত ধরে যে সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের গণতন্ত্রের পথচলা শুরু করে, তা সবসময় মসৃণ ছিল না।
তবে ভারতের গণতন্ত্র সবচেয়ে বেশি বিঘ্নিত হয়েছে চরম ডানপন্থি বিজেপি সরকারের আমলে। মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের তুলনামূলক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক যাত্রা।
২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে মোদি-আদভানির বিজেপি সরকার তার হিন্দুত্ববাদী বা হিন্দু জাতীয়তাবাদের কার্ড ছাড়তে থাকে। যা শুধু সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য শঙ্কার বিষয় ছিল না; বরং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য এটা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমনটা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ, এই বিজেপি’র লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তার সহযোগীরা উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়।
পরবর্তীতে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক গুজরাট দাঙ্গায় প্রায় ১০০০ লোক নিহত, যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ছিল মুসলমান। ওই দাঙ্গার সময় নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। এর ওপর যথেষ্ট নির্মোহভাবে বিশ্লেষণনির্ভর প্রতিবেদন করে বিবিসি। এগুলো ছাড়া ২০১৯-এর নির্বাচনের আগে গো-রক্ষার নামে সংখ্যালঘু মুসলমানদের পিটিয়ে মারা, নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন ২০১৯, আসামের এনআরসি’র মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে বিদেশি ঘোষণা করা, ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর সময় বাংলাদেশ থেকে আসামে যাওয়া বাঙালিদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিজেপির সাম্প্রদায়িক বা পপুলিস্ট রাজনৈতিক কৌশলকে স্পষ্ট করে দেয়। ২০১৯-এর নির্বাচনে ধর্মীয় বিভাজনের কার্ড খেলে বিজেপি এনডিএ জোট ৩০৩ সিটের বিশাল জয় পায়। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের ইউপিএ জোট পায় মাত্র ৫২টি আসন।
এটা ভারতে খুবই প্রতিষ্ঠিত যে উত্তর প্রদেশ যার, দিল্লি তার। অর্থাৎ উত্তর প্রদেশে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তারাই ভারতের ক্ষমতায় আসে। ২০১৯-এর নির্বাচনেও এর প্রতিফলন ঘটে। বিজেপির গেরুয়াধারী, কট্টর-হিন্দুত্ববাদী আদিত্য নাগ ভারতের উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় আসে এবং ২০২০ সালে ‘লাভ জিহাদ’ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ধর্ম পরিবর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে, কেন্দ্রের শাসন জারি করে।
‘বিতর্কিত’ বাবরি মসজিদ রায়কে পুঁজি করে, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ ও তার সাংঘাতিক উদযাপন মুসলিম সম্প্রদায়কে শঙ্কিত করে তোলে, যা ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এভাবে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাকে উসকে দেয় মোদি সরকার। যেখানে ভারতের কালজয়ী রাজনীতিকরা বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষ জাতি নির্মাণে চেষ্টা করে গেছেন, তখন এসব পদক্ষেপ বিজেপির পপুলিস্ট শাসন ব্যবস্থা বা মেজটেরিয়ান পলিটিক্সকে সামনে নিয়ে আসে ও সংখ্যালঘুদের অনিরাপদ করে তোলে।
তাই ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল ভারতের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর। ‘ঈশ্বরের দূত হিসেবে নিজেকে দাবি করা’ মোদির বিজেপি ৪১২ আসনের নিশ্চিত বিজয়ের আগাম প্রচারণা চালাচ্ছিল। ৫৪৩ আসনের ভারতীয় পার্লামেন্টে ৪১২ আসন দরকার পড়ে ভারতের সংবিধান পরিবর্তনের জন্য। প্রোপাগান্ডার ঝড় উঠেছে নির্বাচনের আগে। এরপরও হিন্দুত্ববাদ ও পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষক বিজেপি জোট আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। বিজেপি সমাজবাদী পার্টির কাছে তার উত্তর প্রদেশের মসনদ হারিয়েছে। হেরেছে সাংঘাতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে, মহারাষ্ট্রে, পাঞ্জাবে ও উত্তর ভারতের প্রায় সব প্রদেশে। যদিও বুথফেরত জরিপের মাধ্যমে তাদের বিজয়বাণী প্রকাশ করা হচ্ছিল। কিন্তু, তা চূড়ান্ত ফলাফলের সঙ্গে মেলেনি শেষ পর্যন্ত।
নিঃসন্দেহে এই নির্বাচনে কংগ্রেসের ইন্ডিয়া জোট তুলনামূলক ভালো করেছে। সরকার গঠন করতে না পারলেও এই ফল ভারতের গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম-অধিকারের নিশ্চয়তা আনতে সাহায্য করবে।
এই নির্বাচনে, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে কাশ্মিরের লোকেরা সর্বোচ্চ সংখ্যায় ভোট দিয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিজেপি আমলে কাশ্মিরের মতো রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আর কোনও অঞ্চলই নেই। কংগ্রেস ভারতজুড়ে যে ‘যাত্রা’ ক্যাম্পেইন চালিয়েছিল, তাতে রাহুল গান্ধী জনমতের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে সমর্থ হন তার বক্তব্য আর ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে। কংগ্রেস ও তার শরিক দলেরা সংখ্যালঘু ও সাধারণ জনগণের ভোট পেতে সমর্থ হয়।
তবে ভারতের মূলধারার মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ কংগ্রেস জোটের প্রতি মানুষের সমর্থন ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
এত জনবহুল রাষ্ট্রে সেই তুলনায় তেমন ভোট কারচুপির অভিযোগ আসেনি, এটা এই নির্বাচনের একটা উল্লেখযোগ্য দিক। সত্যি বলতে, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সেভাবে দলীয় দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়েনি। যা ভারতের উদার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে। বিজেপি এবার সরকার গঠন করলেও এবারই হয়তো তাদের প্রকৃত অর্থের জোট সরকার গঠন করতে হবে ইন্ডিয়াতে।
বিজেপিকে তার শরিক দলগুলোর ওপর যথেষ্ট নির্ভর করতে হবে। তাই একচ্ছত্রভাবে প্রভাব বিস্তার এবার আর মোদি সরকার করতে পারবে না। কারণ, তাদের শরিক দলগুলোর মধ্যে অনেকেই সংখ্যালঘু ভোটের ওপর খানিকটা নির্ভরশীল। কংগ্রেসের যথেষ্ট রাজনৈতিক ভুল আছে এবং নেতৃত্বের সংকট কংগ্রেসকে ভোগাচ্ছিল অনেকখানি। তবে, রাহুল গান্ধীর ফিরে আসা ও কংগ্রেস জোটের তুলনামূলক অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ঐতিহ্য তাদের পুনরায় পথ দেখাচ্ছে।
এবারের ভারতের নির্বাচনের ফলাফল প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর গণতান্ত্রিক যাত্রায় কতটা প্রভাব ফেলবে তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে, যখন বিশ্বের বেশিরভাগ ক্ষমতাধর দেশগুলো প্রচণ্ড ডানপন্থি রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে গণতন্ত্র হরণে লিপ্ত, তখন ভারতের জনগণের এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভারতকে তার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম-অধিকার, সংখ্যালঘু নিরাপত্তাসহ আইনের শাসন ব্যবস্থা মজবুত করতে সাহায্য করবে।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।