যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়
পৃথিবী প্রায় মরণাপন্ন, বৈরী পরিবেশ- যা মানুষের তৈরি। তার ফলে প্রকৃতি ঘুরে দাঁড়িয়ে মানুষ ও তার সভ্যতাবিরোধী লড়াইয়ে রত। এটি প্রকৃতপক্ষে এক অর্থে প্রকৃতি ও প্রযুক্তির মধ্যকার লড়াই। বিজ্ঞান নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম দিয়ে মানুষের জীবনকে ক্রমেই উন্নততর, সহজ ও আরামদায়ক করে তুলেছে। আবার অন্যদিকে তৈরি করেছে মানুষকে মারার নানা অস্ত্র। সে অস্ত্রকে করে তুলছে দিনে দিনে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম- এমন চরম উন্নত।
মানুষ হত্যার অস্ত্র তৈরির কাজটি, যেটি উন্নত পশ্চিমা দেশে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠে ক্রমে বর্তমানে সেটি মারণাস্ত্র, সমরাস্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র হয়ে উঠেছে, সেগুলোর আক্রমণের লক্ষ্য মূলত মানুষ। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন জাতি, ভিন্ন বর্ণের, ধর্মের মানুষকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরীহ, নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য এত মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃতি রক্ষার চাইতে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর সমরাস্ত্র বা মারণাস্ত্র তৈরি করে যখন বাণিজ্য-ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করে, তখন মনে প্রশ্ন না জেগে পারে না যে, তাহলে এই পশ্চিমা দেশের কাছ থেকে রপ্তানি হয়ে উন্নয়নশীল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ‘মানবাধিকার’-এর শঙ্কা, মান, সূচক কি পরস্পরবিরোধী নয়?
অর্থাৎ যুদ্ধাস্ত্র যখন বাণিজ্যপণ্য হয়, তার বিপরীতে ‘মানবাধিকার’ কি এসব ভয়ঙ্কর অস্ত্রের আঘাতে মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না? মোটের ওপর সমরাস্ত্র আর মানবাধিকার পাশাপাশি সহাবস্থান করতে পারে না- এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। তাছাড়াও অস্ত্র তৈরি করে, মজুত করে শুধু রাখা হয় না, সেগুলোর উপযোগিতা যাচাই করার জন্য যুদ্ধাস্ত্র তৈরিকারী দেশগুলোর দরকার হয় যুদ্ধের ক্ষেত্র। নতুন নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করা বড় বড় ধনী দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর একটি অলিখিত দায়িত্ব।
কাজটি তারা নানা ভাবে সহজেই করতে পারে। কোনো দেশে, দরিদ্র বা উন্নয়নশীল যে কোনো দেশে ধনী দেশের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে স্বজাতির স্বার্থরক্ষাকারী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতার স্বজাতির স্বার্থরক্ষার কাজের দ- হিসেবে তাদের ‘মৃত্যুদ-’ দিতে, তাদের নিহত হতে দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। অর্থাৎ দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশে পশ্চিমা দেশের স্বার্থহানিকর, স্বজাতির স্বার্থরক্ষাকারী কোনো দেশপ্রেমিক নেতা অথবা সরকারপ্রধান প্রাণে বেঁচে থাকতে পারবে না। আশ্চর্য হলেও সত্য, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা থেকে ইরানের মোসাদ্দেক বা পরে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী চিলির আলেন্দে নিহত হয়েছেন।
লিবিয়ার গাদ্দাফী বা ইরাকের সাদ্দাম হোসেন প্রমুখ দেশপ্রেমিক নেতারা নিহত হয়েছেন স্থানীয় জনগণের মধ্যে তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে যা পশ্চিমা শক্তির সৃষ্টি। সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ লিবিয়া ও ইরাককে এখন করা হয়েছে সন্ত্রাসী, বর্বর, গু-া-বদমাস-মানব পাচারকারীর এবং চরম মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দেশ। মিসরে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সামরিক একনায়ক থেকে ধর্মান্ধ ব্রাদারহুড একসময় কর্তৃত্ব পেল। দেখা গেল, এ ব্যবস্থা হয়েছে খুবই বিপরীত ফলদায়ক।
কেননা, ধর্মান্ধ শাসকের হাতে মানুষের কি বন্দিদশা হয় তা তো ইরান, আফগানিস্তানের জনগণের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। সুতরাং আবার হাতের পাঁচ সামরিক একনায়ককে শেষ পর্যন্ত বাছতে হলো। তবে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মধ্যে কয়েকটি বিজয়ও ঘটেছে। ভিয়েতনামে দেশপ্রেমিক নেতা হো-চি-মিনকে কেন্দ্র করে ভিয়েতনামী জনগণ আমেরিকাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে আজ উন্নয়নের উচ্চ পর্যায়ে উঠে এসেছে। এর আগে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ সময়ে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার নতুন বানানো পরমাণু বোমার পরীক্ষা হলো।
পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়ার আঘাতে ঐ দুই শহরে মারা গেল কয়েক লক্ষ নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু। এই সব মর্মান্তিক মৃত্যু যুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল তাদের মানবাধিকার। ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ন, জাতীয়তাবাদী নেতাকে বন্দি করে যে ক্যু সংঘটিত হয়েছিল, তাতে সুহার্তোর সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল লক্ষাধিক কম্যুনিস্ট নেতা-কর্মী। ইরানে মৌলবাদী নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনীর আমলে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছিল হাজার হাজার কম্যুনিস্ট তরুণ।
এই প্রযুক্তির যুগে নারীর চুল দৃশ্যমান হওয়ার জন্য ইরানী পুলিশের হাতে নিহত হলো তরুণী সামা আমিনি এবং পরে নিহত হলো প্রতিবাদী বহু তরুণ-তরুণী। ফাঁসি হলো অনেকের। কবি ফেরদৌসী, গালিব, ওমর খৈয়াম, রুমি এককালে ইরান, তুরস্কের কাব্য-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল, বিশ্বাস হয় না।
একদিকে উন্নত জীবন যাপনের জন্য বিদ্যুতের কোনো বিকল্প না থাকায় পৃথিবীর বুক খুঁড়ে জীবাষ্ণ জ্বালানিÑজ্বালানি তেল, কয়লা, গ্যাস ইত্যাদি খনি থেকে তুলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, গাড়ি, উড়োজাহাজ, জাহাজ চালানোর জন্য ব্যবহার শুরু করে পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশকে দূষিত করা শুরু হয়। অন্যদিকে দেশে দেশে যুদ্ধাবস্থার সূচনা করে নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মদত দেয় মারণাস্ত্র প্রস্তুতকারী উন্নত দেশগুলোকে। এভাবে আফগানিস্তানের মতো প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ জাতি ও সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সরকার এবং জনমানুষকে বিশাল এক ধর্মান্ধ কট্টর আল কায়েদা ও তালেবানদের মতো এক স্থায়ী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মুখোমুখী করে রেখেছে।
তালেবানরা নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার প্রবল বিরোধী হওয়ায় আফগানিস্তান এখন এক বর্বর যুগের অন্ধকারে পতিত হয়েছে। এখানে শিক্ষিত তরুণদের কোনো চাকরি নেই। তরুণী বা নারীরা চাকরি করা দূরে থাক, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। সেখানে এখন চলছে বোমাবাজি, অকারণ হত্যাকা-, চরম বিশৃঙ্খলা। এক একটি দরিদ্র দেশ এইভাবে ক্ষমতাবান ধনী, অস্ত্র বিক্রেতা দেশের সরকারগুলোর স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ দেশগুলোকে বানানো হচ্ছে অস্ত্র পরীক্ষার যুদ্ধক্ষেত্র। ধনী দেশের নিত্য নতুন অস্ত্র, বোমা, গ্রেনেড, মর্টার, মিসাইল, যুদ্ধবিমান মহড়ার ক্ষেত্র হচ্ছে দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশগুলো।
ইসরাইলি ঘাতক সরকার এবং ইসরাইলি সৈন্যদের অস্ত্রের শিকার হয়ে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে প্যালেস্টাইনি তরুণ, নারী ও শিশু। অথচ পুরো পৃথিবী নির্বাক। এই রকম চরম প্রতিকূল অবস্থায় পশ্চিমারা আসে তাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞা, সূচক ও শর্ত নিয়ে। ইসরাইলিরা যে প্রতিদিন প্যালেস্টাইনি হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করছে, সেটি কি ইসরাইলিদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? ইসরাইল মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমা মিত্র পরীক্ষকদের হাতে কত নম্বর পেয়েছে? আরও দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র মিসাইল হামলা চালিয়ে ইরানী সমরবিদ জেনারেলকে বিনা দ্বিধায়, বেআইনিভাবে হত্যা করেছে কিছুদিন আগে।
এ রকমটা কি করা যায়? পৃথিবীর বহু নেতার হত্যার সঠিক তথ্য উদ্ঘাটিত না হওয়া, যেমন- জন এফ কেনেডি হত্যাকা-, দাগ হ্যামারশোল্ডকে বহনকারী উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা সংঘটন কারা, কেন করেছিল, তা চির অজানাই থেকে গেছে। তেমনি বেনজীর ভুট্টোর হত্যাকা-ের রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়নি। তেমনি প্যালেস্টাইনি নেতাকে সরিয়ে দিতে ইচ্ছুক আমেরিকার এক রাষ্ট্রপ্রধানের নাম শোনা যায় এবং ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু রহস্যও আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।
উপরোক্ত আলোচনা জনমানুষকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি করে- জলবায়ুর উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবী এবং পৃথিবীর জীবজগৎ, পানি, বাতাস সবই প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী। সেখানে মানুষের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা, সহিংসতা, নানারকম সমরাস্ত্র ব্যবহার, অকারণ হানাহানি, হত্যা, লুণ্ঠন, ধ্বংস, মানবপাচারÑ এসবের মধ্যে ‘মানবাধিকার’ কি? কার? কাদের জন্য? এ প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। নতুন নতুন সমরাস্ত্র তৈরি, বিক্রি কি যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকেই বৃদ্ধি করে না?। যেখানে যুদ্ধ কারও জন্য প্রয়োজন, কারও জন্য প্রাণঘাতী- সেখানে ‘মানবাধিকার’-এর প্রশ্ন হাস্যকর প্রহসন হয়ে ওঠে নাকি?
পৃথিবীর বড় উন্নত ধনী দেশের নেতৃবৃন্দ আজ যদি এসব পরস্পরবিরোধী শত শত হঠকারিতামূলক কা- ঘটাতে থাকে, তাহলে পৃথিবী থেকে প্রথমেই পলায়ন করবে ‘মানবাধিকার’ নামের সোনার পাথর বাটিটি। শোনা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে ইউরোপের বড় কয়েকটি দেশসহ যুক্তরাষ্ট্রও। সবার এতদিনকার বিশ্বাস ছিল, চীন শুধু ঐ জান্তাকে অস্ত্র জোগান দেয়। এখন দেখা যাচ্ছে, গোপনে পশ্চিমা দেশগুলো এবং আমেরিকাও জান্তার অস্ত্র জোগানদার।
তাহলে, রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণের অর্থ দিয়ে পশ্চিমারা কিছু দায়িত্ব পালন করলেও, প্রকৃত অর্থে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার দায়দায়িত্ব তারা মোটেও আন্তরিকভাবে করছে না। বাংলাদেশের ওপর এ বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর ভার লাঘবে তারা এ পর্যন্ত কিছু করেওনি। সবার ওপরে পশ্চিমাদের লাভ হচ্ছে অস্ত্র বিক্রিতে। মিয়ানমারের জান্তা ওদের সে অস্ত্র কিনে লাভ দিচ্ছে, এটাই ওদের প্রধান বিবেচ্য। এর পাশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের ওরা থোরাই কেয়ার করে।
বাংলাদেশের ওপর চাপ কমাতে ওরা আগ্রহী নয়, কিছু খরচ দিচ্ছে সান্ত¦না হিসেবে। যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি আর মানবাধিকার একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না। যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আসলে যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হবে না, শান্তি তো দূর অস্ত।
লেখক : শিক্ষাবিদ
momtaylatif2013@gmail.com
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।