নিউজ ডেক্স
আরও খবর
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
এমপি খুন, নিষ্ঠুর সমাজ, মানিক সুনীলের ভালোবাসা
‘ঈদ যাত্রায় ভোগান্তি’ ও ‘বাড়ি’ ফেরার ঈদ আনন্দ
ভারতের ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন ও বাংলাদেশের বিভ্রান্ত বিরোধী দল
ভারতের গণতন্ত্র কি সঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ?
স্মার্ট বাজেট অথবা রূপকল্পের পথে
বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থায়ন
১৫ লাখের ছাগল বৃত্তান্ত !
এম আর ইসলাম
বাংলাদেশ ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট’ এর দেশ। তবে, সম্প্রতি আলোচনার বিষয় দাঁড়িয়েছে কোরবানির এক ছাগল, যার দাম ১৫ লাখ টাকা। দেশ ‘এগিয়ে’ যাচ্ছে; প্রচণ্ড বেগে ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, তার কারণে হয়তো আজ ১৫ লাখ টাকার ছাগল আর দেড় কোটি টাকার গরু দেখতে হচ্ছে! দেশের বেশিরভাগ জনতা আজ দর্শক হয়ে গেছে, খেলছে দুর্নীতিবাজ চাকুরে, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকরা।
আমরা প্রতিনিয়ত খেলা দেখা যাচ্ছি বিশাল স্টেডিয়ামে বসে। তবে, আমরাও মাঝে মাঝে ধূমকেতুর মতো জেগে উঠি, যখন দেখি কারও বিরুদ্ধে জেগে উঠলে বিপদের আশঙ্কা কম। কিছুদিন আগে এক বহুলবিক্রিত পত্রিকার সম্পাদক বলেছেন, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির সাহেবের দুর্নীতির কথা তিনি জানতেন, কিন্তু সাহস করতে পারেননি সে সাতকাহন ছাপাতে।
ছাগল ক্রেতার বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছি, বিপদের আশঙ্কা কম বলে! শক্তিশালী বা বন্দুকবাজদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা বা রঙ্গ করা বঙ্গদেশে সম্ভব না।
ছাগল বৃত্তান্তে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব। প্রাথমিকভাবে, এমনটা খারাপ না। যেখানে সরকারি এজেন্সিগুলোর দায়িত্ব ছিল– দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি আর অর্থপাচারকারীদের চিহ্নিত করা, সে কাজ আজ কিছু দায়িত্বশীল সাংবাদিক আর নেটিজেনরা করে যাচ্ছে! সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষ জানতে পারছে ‘চোর-বাটপার’দের সম্পর্কে। লিখতে পারছে, তামাশা করতে পারছে বিনোদনহীন, বঞ্চিত মানুষের দল। আইন-বিচার নিয়ে বিষন্নতায় ভোগা এদেশের মানুষ জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে অপরাধীদের। এমনটার অনেক ক্ষতিকর দিক আছে বৈকি, কিন্তু এমনটা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে খুব একটা খারাপ না। ব্যাপারটা এমন যেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে না আসলে সব কিছুই জায়েজ ছিল, কেউ কিছু জানতো না।
এবারের কোরবানির পশুর আকার, দাম, আর ক্রেতাদের লোক দেখানো পশু কেনার মচ্ছপ দেখে বোঝা যায়, এদেশের টাকাগুলো কাদের কাছে আর কারাই বা টাকা রফতানিতে ব্যস্ত। দুর্নীতির এমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেখে সাধারণ শিহরিত না হয়ে উপায় নেই। সরকারি চাকরিজীবীদের একটা বড় অংশ দুর্নীতিতে আজ বেপরোয়া। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীরা আজ সরকারি চাকরির প্রস্তুতি ক্ষেত্র বানিয়ে রেখেছে। কোনও মতে, একটা সরকারি চাকরিতেই যেন মিলবে আর্থিক ও সামাজিক মুক্তি, করা যাবে ক্ষমতার সীমাহীন চর্চা, একবিংশ শতাব্দীতেও অন্যকে ‘দাস’ বানিয়ে নিজেরা ‘প্রভু’ সেজে বসার আর কি সহজ তরিকা থাকতে পারে! তাইতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিতে পজিশন থাকা সত্ত্বেও অনেকে ছোটে নির্বাহী ক্ষমতার চাকরিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সীমিত বেতন, উচ্চতর ডিগ্রি নেবার ও গবেষণালব্ধ শিক্ষায় নিয়োজিত করার বাধ্যবাধকতায় কে জড়াতে চাইবে এমন বাস্তবতায়?
এমনকি সরকারি চাকরিতে যাদের একাধিক অপশন তৈরি হয়, তারা চেষ্টা করে, কোনও চাকরিতে অবৈধ উপার্জনের সুযোগ বেশি বা পরাক্রমশালী ক্ষমতাধর হওয়া যায়। কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখলাম, একজন তার সরকারি ক্যাডারের পেশা পরিবর্তন করে, সাব-রেজিস্ট্রার এর চাকরিতে যোগ দিয়েছে। ভূমি ব্যবস্থার দুর্নীতি আর অবৈধ অর্থযোগই বোধ হয়, তার মোটিভেশন।
আমি যখন সারদাহ পুলিশ একাডেমিতে ক্লাস নিতাম, তখন দেখেছি বিচার বিভাগের চাকরি পরিবর্তন করে কেউ কেউ পুলিশ প্রশাসনে যোগ দিয়েছেন। এমনকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে, পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছে এমন নজীরও আছে।
এদেশে রাজস্ব বিভাগের জনৈক কর্মকর্তার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান ১৫ লাখের শখের ছাগল কিনে গলা জড়িয়ে ধরবে, বা উনি আরও ৩৮ লাখ টাকার গরু কোরবানি দিবেন, এমনটা, তো এদেশে অস্বাভাবিক কিছু না। শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিলে, কিছু অর্থ তো আয় করাই যায়। দেশের যে দ্রব্যমূল্য, তাতে সর্বোচ্চ গ্রেডের সরকারি চাকরি করে সংসার চালানোই যেখানে দায়, সেখানে সীমাহীন বিলাসিতার এই বস্তুবাদী জীবন-যাপন অবৈধ অর্থ উপার্জন না হলে চলে না। গুলশান, বনানী, বারিধারার বা ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটগুলোর মালিকদের আমরা চিনি না বটে, কিন্তু এগুলোর দাম আমরা অনেকেই জানি। আট-দশ কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার লোক অগণিত। এদেশে চলে রলস-রয়েস বেনটলি’র মতো দামী সব গাড়ি।
দুর্নীতি একটা সম্মিলিত অপরাধ (syndicated crime)। একজন মিলে এই অপরাধ সংগঠিত করা যায় না। দুর্নীতি যখন দিনের পর দিন ধরে হয়, তখন সেই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। দুর্নীতি করতে একটা সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করা হয়, যারা এই অপরাধের বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত থাকে এবং এর বিভিন্ন রকমের সুবিধা ভোগ করে। এখানে, ব্যক্তির পদ-পদবীই সব নয়, নিম্ন সারির কর্মচারীও অনেক ক্ষেত্রেই, দুর্নীতিতে ছক্কা হাকাতে পারে। আমরা দেখেছি স্বাস্থ্যবিভাগের ড্রাইভারও দুর্নীতির মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে!
‘Size doesn’t matter’ এর মতো ‘rank doesn’t matter in committing corruption’। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে, দুর্নীতি, সে যে লেভেলেই হোক না কেন, তা গোপন থাকার কথা না। কিন্তু, গোপন রাখা হয়। এটা চলে এক অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে!
তবে, দুর্নীতির কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হয়তো নানাবিধ সুবিধা নেয়, কিন্তু দেশ আর দেশের মানুষের সীমাহীন ক্ষতি হয়ে যায়। রাজস্ব কর্মকর্তা দুর্নীতি করলে, দেশ রাজস্ব হারায়; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ দুর্নীতি করলে, মানুষ তার জান-মালের নিরাপত্তা হারায়, সরকারি ডাক্তার ফাঁকি দিলে, মানুষ তার কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা হারায়, বিচারক দুর্নীতি করলে মানুষ তার যাওয়ার শেষ আশ্রয় হারায়। দুর্নীতি, তাই সুশাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি। একটা সময় ছিল, যখন রাজনৈতিক সরকারের পালা শেষে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসতো, তখন অনেক দুর্নীতিবাজই বাড়ি-গাড়ি, টাকার বস্তা ছেড়ে পালাতো। কিন্তু শেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেকেই রাজনৈতিক সরকারের মতো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, যেহেতু তারা অন্যায্য ভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। তারা টেম্পার ধরে রাখতে পারেনি।
আমাদের দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে-পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে বটে, কিন্তু এক অজানা কারণে, সে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন থেকে তারা দূরে সরে যায়।
এদেশের মানুষ দুর্নীতির সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বহুদিন ধরে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশেকে দুর্নীতির শিখরে নিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু আফসোস করে বলেছিলেন যে, ‘তিনি পেয়েছেন চোরের খনি’! দুর্নীতি নিয়ে তিনি অনেক কালজয়ী বক্তৃতা করেও গেছেন তাঁর জীবদ্দশায়। কিন্তু উনি দুর্নীতি নির্মূল করার জন্য যথেষ্ট সময় পাননি। স্বাধীনতা উত্তরকালে, কোনও সরকারই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বেশিরভাগ সরকারই নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে নির্বাহী বিভাগের দুর্নীতিকে সাংঘাতিক ভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে। দুর্নীতিবাজদের দমনের চেয়ে, তোষণ করা হয়েছে বেশি।
দুর্নীতির কারণে, বিগ ভলিউমের বাজেট থাকা সত্ত্বেও, রাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়, জনগণ পায় না তাদের সরকারী পরিষেবা। অন্যদিকে, দুর্নীতিবাজদের দানবাকৃতির ছাগল আর গরু দেখে, মানুষের দিন কাটে ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট করে। দৃশ্যমান কঠোর সাজার ব্যবস্থা না থাকায়, দুর্নীতিবাজেরা আজ অপ্রতিরোধ্য। তবে দুর্নীতিবাজদের ছবি, তথ্য ও তাদের দুর্নীতির ধরন ও কাহিনিগুলো দায়িত্বশীলতার সাথে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারলে ও তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করলে কিছুটা কাজ হতে পারে। যেমনটা হয়েছে কোরবানির এই ‘ছাগল’ কাণ্ডে।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।