আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৪:১৬ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , দৈনিক গণঅধিকার

মা আমার/তুমি কি জান না/গানের পথে তোমার ছেলে/কোনো বন্ধন মানে না/সেদিন দুপুরে/তুফান উঠেছিল সুরের নদীতে ...। সেই সুরটি ছিল বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের। মাতৃভাষার জন্য সেদিন স্বেচ্ছাচারী সশস্ত্রদের বিরুদ্ধে দ্রোহের অনলে জ্বলে উঠেছিল বাংলা মায়ের নিরস্ত্র সন্তানেরা। ফাগুনের তপ্ত দুপুরে লড়াই করে অর্জিত হয়েছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। শেষ পর্যন্ত শোষকের প্রাণঘাতী মারণাস্ত্রও পরাজিত হয়েছিল নৈতিকতার প্রশ্নে জেগে ওঠা শোষিতের হুংকারে। জয়ী হয়েছিল পূর্বপুরুষের মুখের ভাষায় কথা বলতে চাওয়া সাহসী সন্তানেরা। বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসে বাঁকফেরানো সেই দিনটি ছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন দুপুর প্রায় দুইটা পর্যন্ত রাজপথে চলতে থাকে মিছিল। গ্রেপ্তার হতে থাকে রাজপথ কাঁপানো মিছিলে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ছাত্ররা জমাট বাঁধতে থাকে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গেটে। বাংলা বর্ণমালা থেকে প্রাপ্ত সম্মিলিত শক্তির সেই স্লোগানে স্লোগানে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ১৪৪ ধারা নামের নিষেধাজ্ঞা। বিক্ষোভ মিছিলটি এগুতে থাকে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে। ফলশ্রুতিতে শুরু হয় পুলিশের ঝাঁজালো কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ। সঙ্গে বেপরোয়া লাঠিচার্জ এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার। ছাত্রদের সেই সংহতি ও সংগ্রামকে জোরালো করতে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় মেডিক্যাল কলেজের ওয়ার্ডবয়, বেয়ারা, সড়কের পাশের রেস্তোরাঁর কর্মচারী, পথচারী থেকে রিক্সাওয়ালা। এ সময় এমএলএ ও মন্ত্রীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে পরিষদে আসতে থাকেন। উল্টোদিকে মিছিলের শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে পুলিশি নির্যাতন। এক পর্যায়ে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ভেতর পুলিশি আক্রমণের জবাবে পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ছাত্ররা। প্রতিবাদের সেই ঝড়ো হাওয়ায় দিগি¦দিক শূন্য হয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। সেদিন আবুল বরকতের গুলি খাওয়া সম্পর্কে শামসুল বারী (মিঞা মোহন) বলেছেন, ‘সিগারেট ধরিয়ে ২০ নং ব্যারাকের মাঝামাঝি কামরার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিরোচ্ছিলাম। আমার দিকে এগিয়ে এলেন বরকত, ডাকনাম আবাই। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি কিন্তু পড়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতখানেক দূরে। পুলিশ ঢুকে পূর্বদিক থেকে সোজা গুলি ছুড়ছে। সফিকুর রহমান ১৭ নম্বরে থাকতেন, দৌড়ে এসে পানি ঢেলে দিলেন, ভেবেছিলেন টিয়ার গ্যাসের প্রতিক্রিয়া। আমি গুলির কথা বললাম, ততক্ষণে পানির সঙ্গে রক্ত দেখা দিয়েছে বারান্দার মেঝেতে। তলপেটে লেগেছে গুলি। গায়ে ছিল তার নীল রংয়ের ফ্লাইং হাফ শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। তখন তার দুই ঠ্যাং সফিকুর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন আর মাথা নিলাম আমার কাঁধে।... আমার কাছে পানি চাইল কিন্তু কোথায় পানি, সময় নাই, পুলিশ দেখলে কেড়ে নিতে পারে, তাই পড়িমরি করে ছুটছি। ভেজা রুমালটা দিলাম চুষতে। ... সে বললো, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচব না, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেন।’ তাকে নিয়ে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নামলাম। কেউ কেউ কেঁদে ফেলল। একজন নার্স ‘কাপুরুষ’ বলে গালাগালি দিয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য গেটে যেতে বল্লেন। আমি দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই স্ট্রেচারে করে একজনকে মৃতদেহ আনতে দেখলাম। মাথার খুলি উড়ে গেছে। নিচের দিকে খানিকটা ঘিলু ঝুলছে। শুধু দাঁতগুলি দিয়ে হাসছে যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে।...’ সেদিনের ঘটনার ভাষ্যে এম আর আখতার মুকুল বলেছেন, ‘বেলা তিনটা দশ মিনিটের সময় আকস্মিকভাবে একদল সশস্ত্র পুলিশ মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে জব্বার ও রফিকউদ্দীন নিহত হন। প্রকাশ্য রাস্তার ওপর পড়ে থাকা গোটা দুয়েক লাশ পুলিশ নিজেদের ট্রাকে নিয়ে যায়।’ মোহাম্মদ সুলতান বলেছেন, ‘কত রাউন্ড গুলি চলেছিল জানা যায়নি। ... শহীদ হলেন একজন রিক্সাচালক। শহীদ হলেন বরকত, জব্বার, সালাউদ্দিন প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বা রাস্তায় যারা শহীদ হলেন পুলিশবাহিনী সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়ে গাড়িতে তুললেন। ... ১৪৪ ধারা আর রইল না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস মহান তীর্থস্থানে পরিণত হলো। এ ঘটনায় ঢাকার সমস্ত অফিস-আদালত, কল-কারখানা, রেডিও, রেলগাড়ির চাকা বন্ধ হয়ে গেল। রিক্সা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। হাজার হাজার লোক মেডিক্যাল কলেজে এসে জমা হতে থাকলেন। কান্নার রোল পড়ে গেছে চতুর্দিকে। পুলিশবাহিনী সরে পড়েছে। ঢাকার রাস্তায় কোথাও একটি পুলিশ নেই।’ একুশে ফেব্রুয়ারি ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন তা জানার আজ আর উপায় নেই। ভাষা সংগ্রামীদের তথ্যমতে, অনেক লাশ সরিয়ে ফেলেছিল পুলিশ। তবেই জানা-অজানা সেই বীর শহীদদের রক্তঋণে সারাদেশে ছড়িয়েছিল দ্রোহের আগুন।