
নিউজ ডেক্স
আরও খবর

একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়ি উনসত্তরের অনুপ্রেরণায়

ইবাদতের ভরা মৌসুম শুরু হলো

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর গৌরবগাথার মাস

নতুন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘আস্থার ঘাটতি’ কমবে কি?

অর্ধশত পেশাদার সাংবাদিকের সদস্যপদ স্থগিত করায় ডিইউজের উদ্বেগ ও নিন্দা

১৫ লাখের ছাগল বৃত্তান্ত !

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
‘দ্য আর্ট অব স্টোরিটেলিং’

মো. সামসুল ইসলামঃ-
হঠাৎ করেই বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারকে নিয়ে তরুণদের মধ্যে বেশ বিতর্ক হচ্ছে। বাংলাদেশের নামকরা কনটেন্ট ক্রিয়েটর ‘রাফসান দ্য ছোট ভাই’ (প্রকৃত নাম ইফতেখার রাফসান) তার মা-বাবাকে অত্যন্ত দামি ওডি গাড়ি উপহার দিয়ে দেশে হইচই ফেলে দিয়েছেন। অনেকে প্রশ্ন করছেন, পড়ালেখা করে আর কী লাভ! সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য কনটেন্ট তৈরি করলেই তো বেশি আয় করা যায়!
‘রাফসান দ্য ছোট ভাই’-এর কনটেন্ট বা ভিডিও আমি আগে কিছু দেখলেও তাকে নিয়ে এই বিতর্কের পর আবার তার কিছু ভিডিও দেখলাম। তার যে গুণটি আমাকে মুগ্ধ করলো তা হলো স্টোরিটেলিং– বাংলায় যাকে বলে গল্প বলা এবং এক্ষেত্রে তার অপূর্ব দক্ষতা। তার শব্দচয়ন বা কথাবলার স্টাইল এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের মুগ্ধ করেছে এবং শুধু ফেসবুকেই তার ফলোয়ার ৪.৩ মিলিয়ন!
অ্যাটেনশন অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব বাড়ছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ইনফ্লুয়েন্সারদের। আবার এই কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের এক অতি প্রয়োজনীয় দক্ষতা হচ্ছে স্টোরিটেলিং। সুতরাং ‘রাফসান দ্য ছোট ভাই’-এর কৃতিত্বকে খাটো করার কিছু নেই। প্রাযুক্তিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পেশার ক্ষেত্রেও আসছে পরিবর্তন। ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে এআই স্পেশালিস্ট, ডাটা সায়েন্টিস্ট, সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট বা রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারদের মতো কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং ইনফ্লুয়েন্সারদের অনেকে যোগ করছেন।
আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শুধু কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা হিসেবে নয়– প্রকৃতপক্ষে ‘স্টোরিটেলিং’ শব্দটি বর্তমানে সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যম, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে একটি buzzword-এ পরিণত হয়েছে। এটি নিয়ে বইপত্র লেখা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে, অ্যাকাডেমিক জার্নালে আর্টিকেল লেখা হচ্ছে।
গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরের হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর এক আর্টিকেলে বলা হয়েছে, গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এবং তাদের কর্মে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে স্টোরিটেলিংয়ের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে।
এ বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস ম্যাগাজিনের একটি নিবন্ধে বলা হয় যে একটি সুলিখিত ভালো স্টোরি বা গল্প একটি ব্র্যান্ডকে মানবিক করতে পারে এবং এটি ভোক্তাদের সঙ্গে এমন যোগাযোগ তৈরি করে, যা পণ্য এবং সেবা প্রদানের বাইরেও প্রকৃত বিশ্বাস এবং ব্র্যান্ডের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করে।
প্রশ্ন হতে পারে স্টোরিটেলিং কী? সহজ ভাষায় স্টোরিটেলিং বা গল্প বলা হলো, শব্দ, চিত্র বা অন্যান্য মাধ্যমের মাধ্যমে একটি ন্যারেটিভ বা আখ্যান বা বিভিন্ন ঘটনা বোঝানোর শিল্প এবং কৌশল। এটি গল্প বলার এবং আকর্ষণীয় ন্যারেটিভ তৈরির মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করে, আবেগ জাগিয়ে তোলে এবং একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করে।
এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে বিষয়ের প্রয়োজনে এবং স্থানীয়ভাবে আমি এ লেখায় শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় স্টোরিটেলিং বিষয়ে কিছু আলোচনা করছি সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে সম্পর্কিত করে।
স্টোরিটেলিং তো সব মাধ্যমেই হতে পারে, যেমন- ফিল্ম, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি। এটি অনেক ব্যাপক একটি বিষয়, তবে আপাতত বেশি গভীরে যেতে চাই না।
স্টোরিটেলিংয়ের ইতিহাস তো আজকের নয়। মুখে মুখে গল্প বলার ইতিহাস তো প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই হয়ে আসছে। সাংবাদিকতায় এর ব্যবহার সুবিদিত। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে স্টোরিটেলিং এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।
ইনফরমেশন ওভারলোডের কারণে মানুষের মন এখন বিক্ষিপ্ত, তাদের মনোযোগ ধরে রাখা খুব কঠিন। সুতরাং স্টোরিটেলিংয়ের মাধ্যমে মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তাদের হাসানো সম্ভব, কাঁদানো সম্ভব এবং এর যেকোনও বিষয়ে সহজেই অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে।
সামাজিক মাধ্যম হোক বা সাংবাদিকতা হোক, কার্যকর গল্প বলার বা স্টোরিটেলিংয়ের জন্য অডিয়েন্সের পছন্দ-অপছন্দ, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং বর্ণনার কৌশলগুলো খুব ভালোভাবে বোঝা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার সৃজনশীলতা এবং ব্যাপক পড়াশোনা। গল্প বলার অভূতপূর্ব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমাজে বিভিন্ন সেবা দিতে, পণ্য বিপণনে, শিক্ষিত করতে, বিনোদন দিতে এবং অনুপ্রাণিত করতে পারে।
ফেইক নিউজ আর মিসইনফরমেশনের যুগে স্টোরিটেলিং মানুষকে আস্থা ও বিশ্বাস জোগায়। অডিয়েন্স যখন দেখে শুধু নিছক কেনাবেচা নয়, এর সঙ্গে আবেগ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জড়িত, তখন একটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবা কিনতে আগ্রহী হয়। আমদের দেশে বিভিন্ন এনজিও ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো স্টোরিটেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন ভাবনাগুলো দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সামাজিক আন্দোলনেও আমরা স্টোরিটেলিংয়ের ব্যবহার দেখি। সাম্প্রতিককালে মি-টু আন্দোলনের সময় আমরা দেখেছি অনলাইনে নারীদের নির্যাতনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা কীভাবে পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
আবার রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রসঙ্গে আসি। ওর স্টোরিটেলিং দুর্দান্ত। সে যে নাটকীয়তার সঙ্গে তার বাবা মাকে গাড়িটি উপহার দেওয়ার ভিডিও শেয়ার করেছে তা বিশাল এক অডিয়েন্সকে বিমুগ্ধ করেছে। অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের কাছে কেমন লাগবে জানি না, কিন্তু তার টার্গেট অডিয়েন্স মূলত জেন জি– এবং তাদের কাছে সে এক বিরাট আইকন। তার এই অসামান্য দক্ষতাকে অস্বীকার করা যায় না।
দেশের আরেকজন জনপ্রিয় তরুণ কনটেন্ট ক্রিয়েটর, যাকে আমি একজন দক্ষ স্টোরিটেলার হিসেবে মনে করি, তিনি হচ্ছেন বুয়েটের প্রভাষক এনায়েত চৌধুরি। ইউটিউব এবং ফেসবুকে তার লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার। সম্প্রতি রাফসান এবং এনায়েত দুজনই ইউটিউবের সিঙ্গাপুর অফিস থেকে তাদের কাজের স্বীকৃতির জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের পণ্য বা সার্ভিসের প্রমোশনের জন্য তাদের মতো জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে তাদের আয়ের বিভিন্ন সোর্স আছে। গাড়ি কেনা তাদের জন্য কোনও ব্যাপার নয়।
এছাড়া দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও অনেক দক্ষ স্টোরিটেলার আছেন, যারা সামাজিক মাধ্যমে বেশ পরিচিত। স্টোরিটেলিং এমন একটি দক্ষতা, যেটা ব্যবহার করে ডাক্তাররা তাদের চিকিৎসা জনপ্রিয় করে তোলেন, ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রির প্রচেষ্টা নেন, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন আর সাংবাদিকরা গণমাধ্যমে কাজে লাগান।
একবিংশ শতকে স্টোরিটেলিং তরুণদের জন্য একটি অপরিহার্য দক্ষতা। তরুণরা এর মাধ্যমে যেকোনও জটিল ধারণাকে মনে রাখার উপযোগী এবং আকর্ষণীয় উপায়ে উপস্থাপন করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছে। গল্পের মাধ্যমে তরুণরা তাদের বার্তাটিকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারে, সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। এবং এভাবেই তারা সম্ভাব্য নিয়োগকর্তা এবং ক্লায়েন্টদের আকৃষ্ট করতে পারে, আর সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে হয়ে উঠতে পারে সবার পরিচিত মুখ।
লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।