মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিন
দেশে খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ ঋণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
বরং বারবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাদের উৎসাহ দিয়ে আসছেন নীতিনির্ধারকরা।
এ খেলাপ রোধ করার কোনো প্রকার আগ্রহ সরকারের পক্ষ থেকে আমরা দেখতে পাইনি। এ অনাগ্রহের সুযোগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হবে আরও ৪০ হাজার কোটি টাকার অবলোপিত ঋণ। তারপরও কথা আছে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংজ্ঞার মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এই যে খেলাপি ঋণের বাড়বাড়ন্ত, তা হলো সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর জীবনবিলাসের গল্প। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দুটি বড় রোগ দ্বারা আক্রান্ত তার একটি হলো বছর বছর হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার এবং অপরটি হলো দিন দিন খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া। এই খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে না পারার কারণ হিসাবে খোদ অর্থমন্ত্রীর ‘উদাসীনতা’কে দায়ী করছেন অনেকে। সব মিলে খেলাপি ঋণের সামগ্রিক চিত্র আমাদের মনে হতাশার জন্ম দিয়েছে।
ঋণ নিয়ে গত সপ্তাহে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের জুলাইভিত্তিক এক প্রতিবেদনে সাধারণ মানুষের মনে হতাশার বিপরীতে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। একদিকে আমরা বড় বড় খেলাপিকে কিছুই করতে পারছি না, অথচ গরিব কৃষক, যারা স্বল্প ঋণ নিয়েছিলেন কিন্তু সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি, তাদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৯ হাজার ৩৫৭টি সার্টিফিকেট মামলা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক। মাত্র ৩৯৯ কোটি টাকার বিপরীতে এ মামলাগুলো করা হয়েছে। কৃষকদের নেওয়া কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা। মোট মামলার মধ্যে ৭৪ হাজার মামলা রয়েছে, যাদের খেলাপি ঋণ ১ লাখ টাকারও কম। বড় ঋণের বেলায় ২ লাখ কোটি টাকার বিপরীতে মামলা হয়েছে ২ লাখ। অর্থাৎ ধনীদের বিরুদ্ধে গড়ে ১ কোটি টাকার বিপরীতে মামলা হয়েছে একটি। অন্যদিকে গরিবদের বেলায় গড়ে মাত্র ৩৬ হাজার টাকার বিপরীতে একটি করে মামলা করা হয়েছে। এ তথ্যের দ্বারা ধনীর অপরিশোধিত ঋণ আর গরিবের অপরিশোধিত ঋণের আকারের তফাতটা সহজেই অনুমেয়। আমাদের শাসনব্যবস্থা সত্যিই বিস্ময়ের বিস্ময়!
অর্থ মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে কৃষি ব্যাংক। কৃষকদের বিরুদ্ধে করা ব্যাংকটির মামলার সংখ্যা ৫৬ হাজার ৮০০। দাবি করা অর্থের পরিমাণ ২১৯ কোটি টাকা। উল্লিখিত সময়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মামলার সংখ্যা ১৭ হাজার ৫৯৮। অনাদায়ী টাকার পরিমাণ প্রায় ১০৩ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৩৯ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকটি মামলা করেছে ১০ হাজার ২৮৪টি। রূপালী ব্যাংক মামলা করেছে ২ হাজার ৫৫০টি। দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি টাকা। আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই আইন যদি একচোখা হয়, তাহলে তা নিয়ে সমালোচনা হবে। আমাদের আইন সবসময়ই দুর্বলের বিরুদ্ধে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য হলো, বড় বড় রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় খাদের কিনারে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ গরিব কৃষককে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। তাদের ঋণ তো ‘গভীর সমুদ্রে এক ফোঁটা পানির মতো’। অর্থাৎ এতই সামান্য, যা বড়দের তুলনায় শতাংশও আসবে না। এটা অগ্রহণযোগ্য, অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক। আমরাও তাই মনে করি।
তবে হতাশার কথা হলো, এদেশে গরিবের সংকট সহজে মোচন হওয়ার নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, দেশে একটা মহালুটপাটের অর্থনীতি চলমান রয়েছে। বড় ঋণখেলাপি এবং পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এসব দুর্নীতিবাজ লুটেরা এতটাই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী যে তাদের কর্মকাণ্ড দেখলেই বোঝা যায় তারা সরকারের অংশ। অথচ ছোট ছোট দরিদ্র কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা দেওয়া হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মোটেও অবাক হচ্ছি না। কারণ, যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। এর থেকে ভালো কিছু আশা করার সুযোগ নেই।
আমাদের কৃষকদের অবদানের কথা ভুলে গেলে চলবে না। করোনাকালে দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত বিপর্যস্ত ছিল, শুধু কৃষিখাত ছাড়া। শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আমাদের কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন। তাই তারা বিশেষ সুযোগ প্রত্যাশা করতেই পারেন। এর বাইরে বিগত বছরগুলোতে কৃষিঋণ পরিশোধে কৃষকদের ইতিবাচক ভূমিকাকেও আমলে নিতে হবে। গত অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে পুরো ব্যাংক খাত। এ সময় শুধু ঋণ বিতরণ নয়, আদায়ও বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছেন কৃষক, যা আগের বছরে আদায় হয়েছিল ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত বছর কৃষিঋণ আদায় বেড়েছে ৫ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক খাতে কৃষিঋণের স্থিতি বা পরিমাণ ৫২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যা মোট প্রদত্ত ঋণের ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।
শেষে বলতে চাই, আমাদের কৃষকরা নানাভাবেই অবহেলিত। তারা তাদের ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। আজ যে কৃষিপণ্যের দাম এত বেড়েছে, তার ছিটেফোঁটাও কৃষকরা পান না। ঢাকার বাজার থেকে যে ঢেঁড়স আপনি ৬০ টাকা কেজি দরে কিনছেন, কৃষক সেই ঢেঁড়স বিক্রি করেছেন মাত্র ৩০ টাকা কেজি দরে। গ্রামে কৃষকের ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা করলা আপনি ঢাকার বাজার থেকে কিনছেন ৯০ টাকায়। ৩০ টাকার বেগুন কিনছেন ৮০ টাকা কেজি দরে আর কৃষকের বিক্রি করা ৩৫ টাকার লাউ আপনি কিনছেন ৬০-৭০ টাকায়। তারপরও কোনো বিকল্প না থাকায় এদেশের কৃষকরা কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত আছেন।
দেশের যে কোনো বিবেকবান নাগরিকই বলবেন, সামান্য টাকার জন্য গরিব কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা ঠিক হচ্ছে না। আমরা খেলাপি ঋণকে উৎসাহিত করছি না বা উৎসাহ দিতে চাইও না। একইসঙ্গে কাউকে আইনের ঊর্ধ্বেও মনে করছি না। একইভাবে সমাজের কোনো একটি শ্রেণির প্রতি আইনের তীর্যক দৃষ্টিও প্রত্যাশা করি না। কিন্তু কতটা অপরাধে কতটা শাস্তি প্রাপ্য তার একটা সুবিবেচনা তো থাকতেই হবে। আমাদের কৃষকরা ঋণের টাকা পাচার করেন না; আমাদের কৃষকরা ঋণের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করেন না। নেহাতই সমস্যা-সংকটে না পড়লে তারা কোনোদিনই ঋণের টাকা পরিশোধে কুণ্ঠাবোধ করেন না। এর প্রমাণ হলো আমাদের সমাজে তড়তড়িয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিগুলো। বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে ক্ষুদ্রঋণের রিকভারি হার ৯৮ শতাংশেরও বেশি। সুতরাং আমাদের কৃষকদের আমরা চিনি। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাব সার্টিফিকেট মামলাগুলো প্রত্যাহার করে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ সৃষ্টি করার।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।