নিউজ ডেক্স
আরও খবর
নতুন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘আস্থার ঘাটতি’ কমবে কি?
১৫ লাখের ছাগল বৃত্তান্ত !
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব: বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
এমপি খুন, নিষ্ঠুর সমাজ, মানিক সুনীলের ভালোবাসা
‘ঈদ যাত্রায় ভোগান্তি’ ও ‘বাড়ি’ ফেরার ঈদ আনন্দ
ভারতের ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন ও বাংলাদেশের বিভ্রান্ত বিরোধী দল
ভারতের গণতন্ত্র কি সঠিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ?
মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা কেন ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ?
গত ২৮ মে গণমাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এবং রোহিঙ্গা বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার সুবাদে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত যেকোনও সংবাদ আমি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ি এবং সংবাদের অন্তর্নিহিত অর্থ গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি। রীতিগতভাবে এ সংবাদটিও আমি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়লাম এবং বোঝার চেষ্টা করলাম রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না-করার আহ্বান কে জানাচ্ছে এবং কাকে জানাচ্ছে। পাশাপাশি এটাও বোঝার চেষ্টা করলাম, এই আহ্বানের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য কী এবং এ আহ্বানের প্রতিফল কী; এ ধরনের কোনও আহ্বান আদৌ কোনও কাজে আসে কিনা; নাকি এটা কেবলই কূটনৈতিক শিষ্টাচার (ডিপ্লোমেটিক নর্মস), যা মিয়ানমারের ক্ষেত্রে মোটাদাগে ‘অকাজের কাজ’ অন্য কিছু নয়।
সংবাদের অন্দরমহলে প্রবেশ করে দেখলাম, মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং রাখাইনে লড়াইরত আরাকান আর্মি উভয়ই প্রতিপক্ষের মাধ্যমে লড়াইয়ের ময়দানে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত না হয়, সেজন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই নাম প্রকাশ না করা কর্মকর্তা আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ সংবাদের শিরোনাম যতটা গুরুতর মনে হয়েছে, বিষয়টি আদতে অত গুরুতর নয়। যেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক কর্মকর্তা বা ‘বেনামি’ কর্মকর্তাদ্বয় মিয়ানমার সরকারকে এই আহ্বান জানিয়েছেন, কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে, মিয়ানমার সে দেশের জনগণকে বা জনগণের একাংশকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে কিনা, সেটা মিয়ানমারের একান্ত নিজস্ব এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করার বা ‘নাক গলানো’ জেনেভা কনভেনশনের বিরোধী। সুতরাং সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ এ ধরনের আহ্বান জানাতে জানাতে পারে না। আবার পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে যেহেতু বাংলাদেশের নাকের ডগায় মিয়ানমার নিশ্বাস ফেলে নাক কেটে ফেলার উপক্রম করে, তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘নাক গলানো’র বিষয়টি নৈতিক বৈধতা পায়। কারণ নাকেরও নিজের সুরক্ষার অধিকার আছে।
অর্থাৎ যেহেতু রোহিঙ্গা সংকটের একটি অনিবার্য ভুক্তভোগী দেশ বাংলাদেশ, সেহেতু রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশের কথা বলার একটা নৈতিক অধিকার আছে। কেননা মিয়ানমারের সংকটের কারণে রোহিঙ্গারা যখন ‘জান’ নিয়ে সংকটের মধ্যে পড়ে, তখন তার প্রভাব ও প্রতিফল বাংলাদেশকে ভোগ করতে হয়। তাই, অগ্রিম ব্যবস্থা নেওয়ার অংশ হিসেবে মিয়ানমার যাতে এমন পরিস্থিতি তৈরি না করে, সে আহ্বান বাংলাদেশ জানাতেই পারে। কিন্তু মিয়ানমার বাংলাদেশের সে কথা শুনবে বা বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দেবে বা বাংলাদেশের একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কনসার্নকে বিবেচনায় নেবে, এরকম আশা করার কোনও যৌক্তিক কারণ নেই। কেননা মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা না শোনাটাই তার চরিত্রের অংশ করে নিয়েছে। এবং বাংলাদেশও সেটা ভালো করে জানে।
মূলত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র রাশিয়া এবং চীনের লাগামহীন আসকারার কারণে মিয়ানমার ১৯৬২ সালের পর থেকে (২০১১ থেকে ২০২১ সালকে বাদ দিয়ে) রীতিমতো ‘যা খুশি তা করেছে’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনও কথায়, কোনও আইনি নিষেধাজ্ঞা এবং কোনও অর্থনৈতিক চাপাচাপি, কোনও কিছুতেই কিছু হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘কেরিকেচা’ মিয়ানমার পাত্তাই দেয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের আহ্বান তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাবে, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। ফলে, এ ধরনের মৃদু আহ্বানের চেয়ে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া যায় কিনা এবং রাষ্ট্র-টু-রাষ্ট্র কোনও যোগাযোগ স্থাপন করা যায় কিনা, যার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটা উদ্বেগ জানানো যায় কিনা, সেটা অধিক কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গারা কেন মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়? নিশ্চয়ই শখের বশে বা স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ায় না! কেননা মিয়ানমারের ঐতিহাসিক এবং বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের নিজেদের তাগিদে জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যকার লড়াইয়ে স্বেচ্ছায় মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ারও কোনও যৌক্তিক কারণ নেই।
বরং জান্তা সরকার কন্সক্রিপশান আইনের মধ্য দিয়ে জোরপূর্বক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে যোগদান করাচ্ছে এবং রেজিস্ট্যান্স গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্মুখ বন্দুকযুদ্ধে তাদের দাঁড় করে দিচ্ছি। ফলে রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের জান্তা সরকার কর্তৃক রীতিমতো জোরপূর্বক ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে জান্তা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে আরাকানের একটা বড় অংশ আরাকান আর্মির দখল করার পরে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর নাম করে তাদের দলে ভিড়ানোর চেষ্টা করছে তারা। জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। জান্তা সরকার বনাম আরাকান আর্মির সম্মুখ লড়াইয়ে উভয়পক্ষে মারা পড়ে বেচারা রোহিঙ্গারা। এ হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার শানে নুজুল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সত্য হচ্ছে, মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের না জান্তা সরকার না আরাকান আর্মি কেউই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে না। রোহিঙ্গাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়; যার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করা হয় মানবঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে। আরও ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, উভয়পক্ষ রোহিঙ্গাদের “বাঙালি সন্ত্রাসী” হিসাবে শনাক্ত করে।
রোহিঙ্গারা কেন বাঙালি সন্ত্রাসী হিসেবে তকমা পেয়েছে তারও একটা দ্বান্দ্বিক ইতিহাস আছে। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত একটি সংবাদে মন্তব্য করতে গিয়ে আমি এর ঐতিহাসিক এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, এখানে তার খানিকটা পুনরুক্তি করছি।
রোহিঙ্গাদের বাঙালি সন্ত্রাসী হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বয়ান (স্টেট ন্যারেটিভ)। কারণ তারা রোহিঙ্গাদের “অবৈধ বাঙালি অভিবাসী” বা “ইলিগ্যাল বেঙালি মাইগ্র্যান্ট” মনে করে এবং সে মোতাবেক রাষ্ট্রীয় তকমা দেয়। তাই, রোহিঙ্গাদের তারা “বাঙালি সন্ত্রাসী” বলে। এটার আরেকটু আগে থেকে বুঝতে হলে বলতে হবে, আরাকান আর্মির সঙ্গে আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন) দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ২০১৭ সালের ঘটনার পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জোরদার অপারেশনের কারণে আরসা (আরাকার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) বেশ কোণঠাসা। এ সুযোগে আরএসও পুনরায় মাঠে আসার চেষ্টা করে। ২০২১ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করলে আরাকান আর্মি জান্তাবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। তখন জান্তা সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে আরসার সম্পৃক্ততা আছে বলে প্রকাশ্যে উভয়কে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে দাবি করে। আরসার সঙ্গে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গাদের জান্তা সরকার বলে “বাঙালি সন্ত্রাসী”। আরএসওর সঙ্গে সম্পৃক্ত রোহিঙ্গাদের আরাকান আর্মিও বলে “বাঙালি সন্ত্রাসী”। এভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে “বাঙালি সন্ত্রাসী” হিসেবে তকমা পায়।
রোহিঙ্গাদের আপনি নিজের প্রয়োজনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করবেন আবার রোহিঙ্গাদেরই “বাঙালি সন্ত্রাসী” হিসেবে তকমা দিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করবেন, এটা কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সভ্য সমাজের চরিত্র হতে পারে না। সুতরাং মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং আরাকান আর্মি উভয় রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রোহিঙ্গাদের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে এক ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে।
সুতরাং রোহিঙ্গাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করার অর্থহীন মৃদু আহ্বানের চেয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার রাষ্ট্রযন্ত্র এবং জান্তা সরকার যে নতুন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে, সে আওয়াজ তোলা দরকার এবং পশ্চিমা বিশ্ব, যারা নিজেদের মানবতার ডিলার হিসেবে দাবি করে, তাদের অবস্থানকে প্রশ্ন করা দরকার। বর্তমানে মিয়ানমারে বসবাসরত প্রায় ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জীবন যে সংকটাপন্ন এবং নতুন করে নতুন এক জেনোসাইডের মুখোমুখি, সেই আলোচনা সামনে আনা দরকার। কেননা রোহিঙ্গাদের ওপরে যেকোনও ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন, এবং জেনোসাইড সংঘটিত হলে তার অনিবার্য ভুক্তভোগী হবে বাংলাদেশ। ১৯৭৮, ১৯৯১-৯২, ২০১২, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের অভিজ্ঞতা আমাদের সেটাই মনে করিয়ে দেয়।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।