সাইবার নিরাপত্তা আইনের ব্যবচ্ছেদ – দৈনিক গণঅধিকার

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ব্যবচ্ছেদ

ডেস্ক নিউজ
আপডেটঃ ২৩ আগস্ট, ২০২৩ | ৮:৩০
আইন বানানো হয় মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণে। একটি ভালো আইন একটি ভালো সমাজের নিয়ামক। সমাজকে অন্যায়, অপরাধ ও ত্রুটিমুক্ত রাখতে আইন প্রণীত হয়ে থাকে। এজন্য এটিকে সুস্পষ্ট, সম্পূর্ণ এবং দ্ব্যর্থহীন হতে হয়। আইন নিজেই অস্পষ্ট, ত্রুটিযুক্ত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাঙ্ক্ষিত ফলদায়ক হয় না। কোনো আইন যদি হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, নাগরিকের অধিকার হরণকারী এবং বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার, তাহলে তাকে ‘কাল আইন’ বলে বিশেষায়িত করার বিকল্প থাকে না। যুগে যুগে বাংলাদেশ এমন অনেক ‘কাল আইনের’ সাক্ষী হয়েছে। এসব আইন সামগ্রিকভাবে জাতিকে দুর্ভাগ্য এবং অকল্যাণ ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি, পারে না। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ ‘ভালো আইন’ নাকি ‘কালো আইন’ সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে এর আপাদমস্তক ব্যবচ্ছেদ হওয়া দরকার। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা আমাদের একটি খারাপ সময়ের সাক্ষী করেছে। ৫৭ ধারার বিধানটি সম্পূর্ণভাবে মৌলিক অধিকার এবং জনস্বার্থ পরিপন্থি ছিল। সমালোচনা, দাবি এবং চাপের মুখে সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে ৫৭ ধারাসহ আইসিটি আইনের পাঁচটি ধারা বিলুপ্ত ঘোষণা করে; কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আরও বেশি ভয়াবহতা নিয়ে আবির্ভূত হয়। বিরোধী মত দমন ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত হয় আইনটি। এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের টুঁটি চেপে ধরা হয়। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণা বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই হয়েছে ২৭.৪১ শতাংশ মামলা। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এ আইনে হওয়া ১২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘সিজিএস’ এ তথ্য পেয়েছে। ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ নামক অন্য একটি সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ২২৫টি মামলায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪১৭ জন ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়েছেন। যার মধ্যে ৬৮ জন সাংবাদিকও আছেন। অন্যদিকে টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। এ অবস্থান দেশের গণমাধ্যমের নাজুক পরিস্থিতি প্রমাণ করে। নিবর্তনমূলক কালো আইন আখ্যা দিয়ে এটি বাতিলের দাবি ওঠে সর্বত্র। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়। বিতর্কিত কয়েকটি ধারা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন সাংবাদিক, আইনজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্মিলিতভাবে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। রিটটিতে লেখক নিজেও একজন পিটিশনার। হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুলনিশি জারি করেন। রিটটি শুনানির অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থায় ৭ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার এটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব বিধান হুবহু রাখা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইনে। পুরো আইনের সব বিধান, সংজ্ঞায়ন এবং অপরাধের বর্ণনা একই রয়ে গিয়েছে। বিলোপ করা হয়েছে ৩৩ এবং ৫৭ ধারা। ৩৩ ধারায় বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর ইত্যাদির দণ্ড এবং ৫৭ ধারায় সরলবিশ্বাসে কৃত কাজকর্মের দায়মুক্তির বিধান ছিল। আগের আইনের ৫০ ধারার একটি প্রয়োজনীয় উপধারা ৩ বাদ দেওয়া হয়েছে, যেখানে উল্লেখ ছিল ট্রাইব্যুনালে অভিযোগকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী ব্যক্তি ‘পাবলিক প্রসিকিউটর’ বলে গণ্য হবেন। প্রতিটি আইনেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সাইবার নিরাপত্তা আইনে ধারা মোট ৬০টি। এর মধ্যে ১৮টিতে সরাসরি অপরাধ ও দণ্ডের বর্ণনা রয়েছে। এর বাইরে ৪৬(৩) ধারায় ‘তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের গোপনীয়তা’র বিধান লঙ্ঘন করাকে একটি অপরাধ উল্লেখে শাস্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। শাস্তির ক্ষেত্রে ১৭, ২১, ২২, ২৫, ২৬, ২৮, ৩১ এবং ৩২ ধারায় কারাদণ্ডের মেয়াদ কমানো হয়েছে, একেবারে বাদ দেওয়া হয়নি। তবে প্রত্যেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের ক্ষেত্রে যে অধিকতর শাস্তির বিধান ছিল তা পুরোপুরি বিলোপ করা হয়েছে। শুধু দুটি ধারায় কারাদণ্ডের শাস্তি না রেখে কেবল জরিমানার শাস্তি রাখা হয়েছে। এর একটি হলো ধারা ২৯, যেখানে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদির শাস্তি হিসাবে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আগের আইনে এ অপরাধের শাস্তি ছিল ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড। অন্যটি হলো ধারা ৩০, যেখানে আইনানুগ কর্তৃত্ববহির্ভূত ই-ট্রানজেকশনের শাস্তি হিসাবে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। আগের আইনে এ অপরাধের শাস্তি ছিল ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড। অন্যদিকে ১৮, ১৯, ২০, ২৩, ২৪, ২৭, ৩৩ এবং ৩৪ ধারায় কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড দুই-ই পূর্বের মতোই রাখা হয়েছে। অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কিত মোট ১৮টি ধারার মধ্যে ৬টিকে আমলযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য এবং ১২টিকে অ-আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য করা হয়েছে। পূর্বের আইনে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪টি এবং ৫টি। অর্থাৎ অ-আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। ১৬টি ধারায় শাস্তি হিসাবে কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড উভয়ই রয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ৮টিতে শাস্তির পরিমাণ পূর্বের মতোই রাখা হয়েছে। বাকি ৮টিতে শাস্তির মেয়াদ কমানো হয়েছে। অন্য ২টিতে কারাদণ্ডের বিধান বাদ দিয়ে শুধু অর্থদণ্ড রাখা হয়েছে; কিন্তু জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এ দুটি ধারার মধ্যে ২৯ ধারাটি নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। নতুন বা পুরোনো কোনো আইনেই ‘মানহানি’র সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ধারা ২(ধ)-তে বলা হয়েছে, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারার ‘মানহানি’ই এ আইনের ‘মানহানি’ হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় প্রদত্ত ‘মানহানি’র সংজ্ঞাই এ আইনের ২৯ ধারার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু দণ্ডবিধির ৫০০ ধারা অনুযায়ী, মানহানির শাস্তি হলো ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। অপরাধের সংজ্ঞা একই, একটি ডিজিটাল মাধ্যমে অন্যটি প্রিন্টসহ অন্যান্য মাধ্যমে। জরিমানা ছাড়া ২ বছর কারাদণ্ড বা কেবল জরিমানা বা উভয় দণ্ড যা-ই হোক না কেন ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিনতর। প্লাটফরম ভিন্ন হওয়ার কারণে একই অপরাধের ভিন্ন বা উচ্চতর শাস্তি হতে পারে না। সংবিধানের ২৭, ৩১ এবং ৩৫ অনুচ্ছেদ বিবেচনায় ২৯ ধারাটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও বাতিলযোগ্য। আবার নিয়ম অনুযায়ী মানহানির মামলা করতে হয় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির নিজেকে। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালত ২৩ বিএলসির ৮১৫ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত ‘কামার উদ্দিন চৌধুরী বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য’ মামলায় সুস্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন; কিন্তু সেটি মেনে চলা হয় না। অজ্ঞতা এবং বিভিন্ন চাপের কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে এটির যথেচ্ছ এবং অবৈধ ব্যবহারও হচ্ছে অহরহ। গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ২৯ ধারাটি খড়্গসম। ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ করলেই এ ধারায় অভিযুক্ত হতে হয়। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন অনেক সংবাদই সাংবাদিকরা প্রকাশ করে থাকেন, যার মাধ্যমে কারও না কারও মানহানি ঘটতেই পারে; যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অন্যায় বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত কেউ হয়ে থাকেন। পত্রিকার সংবাদের ভিত্তিতে এ দেশে অনেক অপরাধ এবং অপরাধী সামনে এসেছে। বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থাও হয়েছে। ঘুস, দুর্নীতি, অর্থ ও মানব পাচারসহ বড় বড় অপরাধ রোধ এবং সুশাসন নিশ্চিতে এমন সংবাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের শাস্তির আশঙ্কা থাকা অবস্থায় কোনো সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কারাভোগ করা জরিমানা গোনার চেয়ে ঢের সহজতর। এমন পরিস্থিতিতে একজন সাংবাদিককে অনেক ক্ষেত্রেই পেশাগত দায়িত্বপালনে পিছপা হতে বাধ্য হতে হয়। স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য আরেকটি বড় বাধা হলো আইনটির ১৭ ধারা। এ ধারার দফা ২(ক) অনুযায়ী, ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’তে বেআইনি প্রবেশ করলে অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং দফা ২(খ) অনুযায়ী বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন বা বিনষ্ট বা অকার্যকর করলে বা করার চেষ্টা করলে অনধিক ৬ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। ইতোমধ্যে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ২৯টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসাবে ঘোষণাও করা হয়েছে। এর ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। বড় অসুবিধা হলো, ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’র তালিকা ঘোষণা করা হলেও কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা দেওয়া হয়নি। মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশের জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। শুধু সংবাদকর্মী নয়, এর মাধ্যমে জনগণের অবাধ ও নিরপেক্ষ তথ্য লাভের অধিকারও খর্ব করা হয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় ‘অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন’ একটি জনপ্রিয় স্লোগান। তথ্য লুকিয়ে নয়, প্রকাশেই কল্যাণ। অপরাধ হ্রাস, সুশাসন ও টেকসই গণতন্ত্রের জন্য এটি অপরিহার্য। অথচ এ ১৭ ধারার কারণে তা কোনোভাবেই হওয়ার নয়। ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’র (UDHR) ১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রত্যেকের মতামত প্রকাশের অধিকার, তথ্য ও ভাব ধারণা অন্বেষণ করা, গ্রহণ করা ও প্রদান করার অধিকার রয়েছে। ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি’র (ICCPR) ১৯ অনুচ্ছেদেও এসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে এগুলোর পূর্ণ স্বীকৃতি পেয়েছে। সেখানে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ বা প্রচারের ক্ষেত্রে আইনের বেড়াজালে আটকে যেতে হয় এবং পীড়াদায়ক শাস্তির খড়্গ মাথার ওপর ঝুলতে থাকে। আইনটির ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড বর্ণিত হয়েছে। এখানে অনধিক ৭ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালানো ব্যক্তিকে যিনি মদদ প্রদান করবেন তারও একই শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখানে শাস্তির পরিমাণ বিশেষ করে অর্থদণ্ড এত বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় হলো, যেহেতু অপরাধটি রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কিত, সেহেতু এসব বিষয়ে মামলা করার ক্ষেত্রে সরকারের ‘পূর্বানুমোদন’ (Sanction) গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও এ ধরনের মামলা করার এখতিয়ার থাকা যাবে না। এই মামলা থানায় এজাহারের মাধ্যমে নয় বরং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত ‘অভিযোগ’ (Complaint) দায়েরের মাধ্যমে হতে হবে। দণ্ডবিধির ষষ্ঠ অধ্যায়ে বর্ণিত ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ’সমূহের অভিযোগে মামলা করার ক্ষেত্রে এমন পদ্ধতির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী এ বাধ্যবাধকতা আরোপিত হয়েছে। ১৯৬ ধারাটি দণ্ডবিধির ২৯৫ এ ধারার ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রেও একই বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে। সুতরাং, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রেও একই রকম বাধ্যবাধকতা প্রয়োগ হওয়া জরুরি। প্রসঙ্গত, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় বর্ণিত ‘মদদদাতা’ কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবে, কী করলে মদদ দেওয়া বোঝাবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অনুপস্থিত। এ অস্পষ্টতা দূর না করলে এবং সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না দিলে আইনের অপপ্রয়োগের যথেষ্ট সুযোগ এবং আশঙ্কা থেকে যাবে। একইভাবে ২৫ ধারায় আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করাকে অপরাধ বলা হয়েছে। ২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে কোনো কিছু প্রকাশ, প্রচার করাকে অপরাধ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। ৩১ ধারায় বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয় এমন কোনো কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করা অথবা করানোকে অপরাধ বলা হয়েছে। এ তিনটি ধারায় সংশ্লিষ্ট অপরাধের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেক জটিল ও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যথাযথ স্পষ্টীকরণ বা সংজ্ঞায়ন না থাকায় এগুলো সাধারণ নাগরিকদের কাছে সহজে বোধগম্য হবে না। অন্যদিকে ৩৪ ধারায় বর্ণিত ‘অপরাধ সংঘটনে সহায়তা’র (Abetment) শাস্তির উল্লেখ করা হলেও এর সংজ্ঞায়ন করা হয়নি। এমনকি দণ্ডবিধির ১০৭ ধারায় বর্ণিত ‘মানহানি’র সংজ্ঞাই এখানে প্রযোজ্য হবে কি না, তাও উল্লেখ করা হয়নি। এসব অস্পষ্টতা, ত্রুটি ও অসংলগ্নতা দূরীকরণে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞার দরকার ছিল। তাতে অন্তত নাগরিকদের জন্য আইনটি সহজবোধ্য হতে পারত। অতএব এক্ষেত্রেও আইনের অপপ্রয়োগের সুযোগ বিদ্যমান। ইচ্ছামতো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নাগরিকদের হেনস্তা করার আশঙ্কা সুস্পষ্ট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চিন্তার বিষয় হলো আইনটির ৪২ ধারা। এ ধারায় পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধারাবলে পুলিশ চাইলে সন্দেহের তালিকায় ফেলে যে কোনো ব্যক্তির ঘরবাড়ি বা অফিস, দেহ বা ব্যক্তিগত ডিভাইস ইত্যাদি তল্লাশি করতে এবং তাকে গ্রেফতার করতে পারবে। সন্দিগ্ধ অপরাধ আমলযোগ্য নাকি অ-আমলযোগ্য বা আদৌ অপরাধ হয়েছে কি হয়নি, তা দেখার কিছু নেই। আর এজন্য পুলিশের কোনো ওয়ারেন্ট বা আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। আইনই তাকে বাধাহীন সুযোগ দিয়েছে। এখানেই ভয় এবং শঙ্কার প্রশ্ন। এই ৪২ ধারাটি দমন-পীড়নের হাতিয়ার হওয়ার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হলেও ৫৯ ধারার বিধানবলে ওই আইনের আওতায় গৃহীত সব কার্যধারা বা মামলা বা আপিল এমনভাবে চলমান থাকবে, যেন তা সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনেই সূচিত। অতএব যারা আগের আইনের প্রয়োগে হয়রানি, নিপীড়ন, গ্রেফতার বা মামলার শিকার হয়েছেন, তাদের জন্য নতুন আইন কোনো সুখবর আনতে পারেনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মন্দ দিক এবং এর অপপ্রয়োগের বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই স্বীকার করেছেন। এ স্বীকৃতির পর ওই আইনে গৃহীত কার্যধারা বা মামলাসমূহ টিকিয়ে রাখা স্ববিরোধিতার শামিল। এটিকে নৈতিকতাবিবর্জিত বললেও অত্যুক্তি হবে না। সরকারের উচিত বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া। মো. আসাদ উদ্দিন : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট asadiuk@yahoo.com

দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ট্যাগ:

সংশ্লিষ্ট সংবাদ:


শীর্ষ সংবাদ:
দৌলতপুরে ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে র‍্যালি ও পথসভা কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে অনুষ্ঠানের বাড়িতে মারামারি সাবেক সদস্য প্রীতি সমাবেশ করেছে ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে গণঅধিকার পরিষদ দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যুদ্ধ-পরিস্থিতির মতো সতর্ক থাকতে বললেন ড. ইউনূস ভরিতে ২ হাজার টাকা বেড়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্বর্ণের দাম ‘বাজারে সিন্ডিকেট থাকলে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’ কারাগারে থাকা সাবেক মন্ত্রীর স্ট্যাটাস ‘ভাইরাল’যা বলল কারা অধিদপ্তর ৪৮ ঘণ্টায় ১০০-র বেশি কম্পন, বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা শেরপুরে আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি দখলের অভিযোগ কবিতা – বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে যে কারণে ভারতকে আর ছাড় দেবে না বিজিবি আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের অনুমতি দেওয়া হবে যে শর্তে! সীমান্ত হত্যা বন্ধে যে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ! আমেরিকা দখল কেন অসম্ভব? নির্বাচনে বিএনপি ডাকলে দেশে ফিরবেন মেজর ডালিম, রাশেদরা? ইবি ডিবেটিং সোসাইটির আহবায়ক ইরানী, সদস্য সচিব দিদারুল সাবেক ২ নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ১৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা শালিখায় ৩০পিচ ইয়াবাসহ এক মাদক কারবারি আটক কেশবপুরের সাগরদাঁড়ীতে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলার উদ্বোধন