নিউজ ডেক্স
আরও খবর
বিচার বিভাগ থেকে যেন কোনো অবিচার না হয় : আইন উপদেষ্টা
গার্মেন্টস খাতে অস্থিতিশীলতায় প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন: শ্রম সচিব
হত্যাকারীদের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে রেখে ভালো কিছু সম্ভব না: মির্জা ফখরুল
পিতাপুত্রের টাকা পাচার
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সরকারি কলেজের দাপুটে শিক্ষক মহোদয়দের অনৈতিক কার্যকলাপ
ত্রাণ নিয়ে মানুষ ছুটছে টিএসসিতে
ভারতের বাঁধ ভাঙা পানিতে ডুবছে গ্রামের পর গ্রাম
সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লারে!
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন প্লান্টে অক্সিজেন সিলিন্ডারে নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার বিস্ফোরণেই প্রাণহানি ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাত্র ২ সেকেন্ডের তাণ্ডবলীলায় প্লান্টের চারপাশে আধা বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু এই একটি কারখানাই নয়, আশপাশের আরও কয়েকটি কারখানা ও প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুটি কারণে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে তারা মনে করছেন। এর একটি হলো-প্লান্টে ব্যবহৃত বয়লারটি ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। সেটি রক্ষণাবেক্ষণও সময়মতো করা হয়নি। আবার বয়লারে জমে থাকা ‘আইস’ বা বরফের কারণেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এ দুটি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বা সুনির্দিষ্টভাবে এখনো কিছু জানায়নি তদন্ত কমিটি।
বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে জেলা প্রশাসন ৭ সদস্যের যে কমিটি গঠন করেছে। কমিটি রোববার থেকে তদন্ত শুরু করেছে। কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির সদস্য ও সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন। এদিকে ঘটনার পর থেকে প্লান্টের মালিকপক্ষ গা-ঢাকা দিয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি কদমরসুল এলাকায় নেমে সরু পথ ধরে কয়েকশ গজ যাওয়ার পর হাতের বামে সীমা অক্সিজেন প্লান্ট। ওই সরু সড়কের দুই পাশে রয়েছে কয়েকটি স্টিল রি-রোলিং মিল, তেলের রিফাইনারিসহ বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানা। রয়েছে কয়েকটি মুদি ও চায়ের দোকন। কিছু বসতবাড়িও রয়েছে। বলতে গেলে লোকালয়েই এই প্লান্টের অবস্থান।
রোববার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে মনে হলো, এটি কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা। সেমিপাকা টিনশেডের কারখানাটি পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পাশের তিনতলা একটি ভবনেও রয়েছে জানালার কাচ কিংবা দরজা ভাঙাসহ বিস্ফোরণের ক্ষতচিহ্ন। প্লান্টটি ৪০ শতক জায়গার ওপর। চারপাশে ইটের মোটা দেওয়ালের ওপর স্টিল স্ট্রাকচারে এটি গড়ে তোলা হয়। প্লান্টের পশ্চিম পাশের দেওয়াল তুলার মতো উড়ে গেছে। দরজা-জানালার অস্তিত্ব নেই। লোহার অ্যাঙ্গেলগুলোও বেঁকে গেছে। সীমা অক্সিজেন প্লান্ট প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত অক্সিজেন সিলিন্ডার, সাদা এক জাতীয় পাউডার ও লোহার টুকরো। ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি ট্রাক। কারখানা থেকে ৫০-৬০ গজ দূরে গিয়ে পড়েছে লোহার টুকরো। শুধু তাই নয়, প্রায় ৭০০ গজ দূরে ছিটকে পড়া লোহার টুকরোর আঘাতে একজনের প্রাণহানিও হয়েছে। শামসুল আলম নামের ওই ব্যক্তি সেখানকার একটি চায়ের দোকানে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানান।
দেখা গেছে, সীমা অক্সিজেন প্লান্টের পাশে থাকা এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস, রুবাইয়া অক্সিজেন লি., রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লি. ও রুবাইয়া প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও রয়েছে আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। এসব প্রতিষ্ঠানের স্টিলের স্ট্রাকচার, কারখানার যন্ত্রপাতি, প্রতিষ্ঠানের দরজা-জানালাও তুলার মতো উড়ে গেছে। পাশের তিনতলা একটি ভবনের দেওয়াল ধসে গেছে। এইচ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক রুবেল জানান, সীমা অক্সিজেন প্লান্টের বিস্ফোরণে তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, প্রয়াত শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফির গড়ে তোলা ‘সীমা অক্সিজেন প্লান্ট’ চালু হয় ২০১৮ সালে। এটি চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি। কারখানাটি বর্তমানে তার তিন ছেলে মামুন উদ্দীন, আশরাফ উদ্দীন ও পারভেজ উদ্দীন পরিচালনা করেন। এখানে পাঁচটি প্লান্ট থাকলেও চারটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। চালু রয়েছে শুধু একটি। প্লান্টটিতে এক শিফটে ১২-১৪ জন শ্রমিক কাজ করতেন। শনিবারও সমসংখ্যক শ্রমিক ছিলেন। নিহতদের মধ্যে ৫ জন তাদের শ্রমিক। একজন এলাকাবাসী। আহতদের বেশিরভাগই পথচারী ও আশপাশের বাসিন্দা। সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডে উৎপাদিত অক্সি-এসিটিলিন গ্যাস লোহার পাত কাটা ও লোহা গলাতে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় বিশেষ করে জাহাজভাঙা ও স্টিল রি-রোলিং মিলে এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিদ বলেন, কী কারণে বিস্ফোরণ তদন্ত না করে বলা সম্ভব নয়। রাতে কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণার পর আর কেউ নিখোঁজ থাকার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেননি। তল্লাশি করে আমরাও নিশ্চিত হয়েছি, আর কোনো লাশ কিংবা আহত কেউ নেই। আবারও আগুন লাগতে পারে এমন সব উৎসও আমরা বন্ধ করেছি। এরপরও যেহেতু সেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে, আবার কোনো দুর্ঘটনা যাতে না হয়, সেজন্য কারখানার নিরাপত্তায় দুটি ইউনিট রেখেছি। উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে মালিকপক্ষকে কারখানা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আর মালিকপক্ষের কাউকে না পেলে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
দুই কারণে হতে পারে বয়লার বিস্ফোরণ : মূলত দুই কারণে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লষ্টিরা মনে করছেন। গত সপ্তাহে চীনা একটি প্রতিনিধি দল বয়লার পরিদর্শন করে যায়। তারা বয়লারটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলেও মালিকপক্ষকে জানান। মালিকপক্ষ রমজানের পর বয়লারটি সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বয়লারে জমে থাকা বরফের কারণেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।
অক্সিজেন প্লান্ট পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল কর্মকর্তা মো. জিহাদ বলেন-কেমিক্যাল, পানি ও গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করে অক্সিজেন তৈরি করা হয়। কেমিক্যাল ব্যবহার করার ফলে বয়লারে বা (কলমে) এক ধরনের আইস বা বরফের স্তর তৈরি হয়। কিছুদিন পরপর তা পরিষ্কার করতে হয়। কিন্তু সীমা অক্সিজেন প্লান্টে কিছুদিন আগে বেশকিছু অভিজ্ঞ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। নতুন কিছু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। নতুন নিয়োগ করা শ্রমিক অদক্ষ হওয়ার কারণে তারা হয়তো জমা হওয়া আইসগুলো সরিয়ে নেয়নি। আইসগুলো জমতে জমতে এক সময় বোমার মতো শক্তিশালী রূপ ধারণ করে বয়লারকে বিস্ফোরিত করেছে।
তদন্ত শুরু : জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। রোববার দুপুর ১২টায় কমিটি বৈঠকে মিলিত হয়। এতে তদন্তের কর্মপরিধি নির্ধারণ করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, আমিও তদন্ত কমিটির সদস্য। তদন্ত অলরেডি শুরু হয়েছে। কী কারণে কার অবহেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে তা নির্ণয় করার চেষ্টা করা হবে।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানকে। অন্য সদস্যরা হলেন-সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ, জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিপ্তরের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধি এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রতিনিধি।
মালিকপক্ষ লাপাত্তা : ভয়াবহ বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরও সীমা অক্সিজেন প্লান্টের মালিকপক্ষের দেখা পায়নি প্রশাসন ও সংবাদকর্মীরা। ঘটনার পর থেকে মালিকপক্ষ গা-ঢাকা দিয়েছে। শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফির মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তার তিন ছেলে মামুন উদ্দীন, আশরাফ উদ্দীন ও পারভেজ উদ্দীন। তবে প্লান্টটির ব্যবস্থাপক আবদুল আলিম জানান, মালিকপক্ষ ঘটনাস্থলে না এলেও তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন। নিহত ও আহতদের পরিবারকে সর্বাত্মক সহযোগিতাও করা হচ্ছে।
মামলা করবে পুলিশ : সাধারণত কোনো দুর্ঘটনা হলে পুলিশই মামলা করে। এ ঘটনায়ও পুলিশই মামলা করবে বলে জানিয়েছে।
তিনতলা ভবন প্রাণহানি কমিয়েছে : সীমা অক্সিজেন প্লান্টের ঠিক পূর্ব পাশে হারুন নামে এক ব্যক্তির তিন তলাবিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে। বিস্ফোরণ সরাসরি ভবনটিতে আঘাত করে। ফলে ভবনটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পাশের অন্য ভবনগুলো রক্ষা পায়। ভবনটির পাশে থাকা দোকানদার নুরুচ্ছফা বলেন, ভবনটি না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব থাকত না। দোকান উড়ে যেত।
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।