
নিউজ ডেক্স
আরও খবর

কবিতা – বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে

মেহেরপুরে ৫ দিনব্যাপী ভ্রাম্যমাণ বইমেলা ও সাংস্কৃতিক উৎসব

অবশেষে জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’ প্রসঙ্গে

ত্রিশালে শুরু হলো জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তী

রণজিৎ গুহ : ইতিহাসের ‘ঝোড়ো হাওয়া’

ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কার পেল জার্মান উপন্যাস ‘কাইরোস’
প্রিয় দশ
অসীম সাহা

নবজন্ম
আমি জন্ম থেকে এইভাবে নিজেকে রেখেছি হিমগৃহে।
চারপাশে ঝরাপাতা, স্বপ্নময় শিলা; একাকী বাউল
যেন ছায়াপরিবৃত অর্ঘ-উপচার নিয়ে মুদে আছে
তন্দ্রাহীন চোখ দুটি তার। এইভাবে জমে ওঠে ব্যথা,
এইভাবে জমেছিলো ব্যথা— আর আদিম উৎস থেকে,
নিবিড় তমসা-ভেদি আকাঙ্ক্ষার বীজ থেকে উঠেছিলো
ধুলোমাটিঘেরা এক সভ্যতা, মগ্ননিবিড় বালুচর।
মনোলতা বেয়ে-বেয়ে এমনি করেই তার উঠে আসা,
এমনি করেই তার কৃষিকাজ, ঢেলামাটি ভেঙে-ভেঙে
ফসল ফলানো, বিষধর সাপেদের সাথে ঠোকাঠুকি।
এইভাবে হেঁটে আসা, ধোঁয়ার মতন কাঁচা কুয়াশার
ছায়া থেকে জোনাকির মতো ছুটে আসা, ধীরে আরো ধীরে
সমুদ্রের খেলা ছুঁয়ে দেয়া, সমুদ্রের বিস্তৃতি জড়ানো।
অথচ আমি জন্ম থেকেই নিজেকে রেখেছি হিমগৃহে
এই ক্রূর অন্ধকার থেকে মানুষের কাছে যাব কবে?
সিদ্ধার্থ
সময় যাচ্ছে ছুটে বাতাসের চেয়ে দ্রুত আকাশের সামানা পেরিয়ে;
একটি সাজানো ফুলে
মুগ্ধ আর বিহ্বল এই আমি বসে আছি স্নিগ্ধ প্রজাপতি।
এই তো সামান্য দূরে দৃষ্টির সীমানায় উঠে আসা এই ধর্মগৃহ;
তাকে ঘিরে ক্ষিপ্ত মৌমাছির মতো প্রতিহিংস্র মানুষের দল
অন্যদিকে তার মাঝে কম্পমান
অসহায় মানুষের তীব্র আর্তনাদ;
ক্রন্দন, আর্তনাদ, জ্বলন্ত আগুন আর তাকে ঘিরে ধর্মান্ধ উল্লাস
সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে অকস্মাৎ ঝলসে ওঠে বজ্রের মতন।
এই দৃশ্য চোখ মেলে কখনো দেখিনি,
দৃষ্টির অন্ধতায় বুঝিনি এ-হিংস্রতা কতটা গভীর;
ফুলের বাগানে আমি ধীরস্থির দৃষ্টির আঘ্রাণে
যেইভাবে বসে আছি মুগ্ধ প্রজাপতি,
ভুলে আছি পরিপার্শ্ব, মানুষের আর্তনাদ, ধর্মান্ধের সুতীব্র দহন—
সেইখানে প্রকৃতি আমাকে কোনো সুঘ্রাণ দেবে না
প্রজাপতি ফিরে যাবে ফুলের সৌরভ ছেড়ে অন্য কোনো ঘাসে
হওয়ার ডানায় ভেসে পাখিগুলো আসবে না আমার আকাশে
আমি একা রয়ে যাব অনড় শেকড় হয়ে অন্ধকার ঘরে!
আমার দৃষ্টির কাছে জেগে আছে স্বচ্ছ জলের মতো
ভারাতুর স্মৃতি : আমার শৈশব আর আমার কৈশোর;
আমি এক পলাতক মৌমাছি— শীতের মৌসুম শেষে
নিজস্ব শহর থেকে একা-একা অন্ধাকারে পালিয়ে এসেছি।
আঙিনার প্রতিটি বৃক্ষ খুব চেনা স্বরে
এখনো আমাকে ডাকে— পুকুরের নীল জলে ভেসে থাকা
হেলাঞ্চের পাতাগুলো মাথা নেড়ে
কী যেন গোপন কথা বলে যেতে চায়।
মন্দিরের পাশে ওই ছয়াঘেরা আমার নিজের ঘর;
চালতাফুলের ঘ্রাণে ব্যাকুল আমার চোখ ঘুরে আসে
পেছনের সবুজ বাগান;
অদূরে তাকিয়ে দেখি কালীবাড়ি, শীর্ণ সবুজ পথ
এঁকেবেঁকে চলে গেছে শৈশবের স্মৃতির ভেতরে।
দক্ষিণের দরোজায় মেঝেতে মাদুর পেতে
আমার পিতার চোখ ডুবে আছে গ্রন্থের পাতায়—
স্বর্গের দেবতা যেন মর্তের আহ্বানে নেমে এসে
এইখানে চিরস্থায়ী আসন পেতেছে।
আমার মায়ের মুখ ভেসে উঠছে উনুনের জ্বলন্ত আগুনে
তাঁর উষ্ণকোমল হাত আমার চুলের মাঝে বিলি কাটে
কী করুণ ব্যথায় কাতর!
সেই প্রিয় ঘর আর প্রাঙ্গণের ভালোবাসা ফেলে রেখে
এখন এ-শহরের এক কোণে উদ্বাস্তু কবি আমি
সান্ত্বনা খুঁজে ফিরি ব্যর্থতার বিষণ্ন বাতাসে।
একটু-একটু করে আমার অন্ধ চোখ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়;
অকস্মাৎ প্রবল আঘাতে
চোখ মেলে চেয়ে দেখি সবকিছু দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ খুব
সবকিছু প্রান্তরের মতো খুব একা।
অথচ এখানে আকাশ খুব স্বচ্ছ নয়।
দিগন্তরেখায় ভাসে অসংখ্য ঈগল।
তাদের হিংস্র নখে জ্বলে ওঠে অসহায় মানুষের করুণ চিৎকার;
যেন ক্ষিপ্ত চিতার কাছে পরাভূত ভয়ার্ত হরিণ—
ছুটে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ে— সুন্দরবনের এক নিভৃত আড়ালে।
এইভাবে অনেক বছর ধরে ভয়ার্ত হরিণেরা অন্ধকারে ছুটে যায়
একটি অরণ্য থেকে আরো এক গহীন অরণ্যে।
আমার ভেতরে কোনো সংশয় ছিলো না কখনো
এখানে প্রতিটি গাছের দিকে তোমাদের মতো আমি
তাকিয়ে বলেছি : ভালোবাসি প্রিয় মাতৃভূমি
তোমাদেরই মতো আমি মাটিকে চুম্বন করে বলেছি : স্বদেশ।
ঘাতকের দুই চোখ তবু কেন আমাকে তাড়িয়ে ফেরে
আমাকে জানিয়ে দেয় তোমার স্বদেশ নয় এই মাতৃভূমি—
তুমি তো পথিক এক— তোমার তৃষ্ণার জল এখানে পাবে না;
এই তীব্র প্রতিধ্বনি আমার শরীরে তোলে ঘন শিহরণ!
এই আঁধারে
আকাশে খুব মেঘ ছিল আর বাতাস ছিল ভারী
মেঘেরা সব গাইছিল গান— কানাড়া-দরবারি।
বজ্র তখন বুকের ছিলায় তীব্র করে টান
গর্জে উঠে আকাশকে দেয় তুমুল আপমান।
জানলা ধরে করুণ সুরে কাঁদছো তুমি একা
ভেবেছিলাম মেঘের ফাঁকে তোমার পাব দেখা।
অন্ধকারে সঙ্গোপনে দৃষ্টি দেয়ার ছলে
তোমার পানে চোখ ছুঁড়ে দিই সিক্ত চোখের জলে।
তখন তুমি উথাল-পাথাল ভাসাও সারা বুক
ডাকতে থাকো আকুল হয়ে— বিষাদমাখা মুখ।
সাত আকাশের ওপার থেকে তোমার সাড়া পেয়ে
বজ্র চিরে আসছি আমি— তাও জানো না মেয়ে?
আমি তো সেই সাত-জনমের হৃদয়হরণ-প্রিয়
এই আঁধারে তোমার যা-সব-উজাড় করে দিও।
পুনরুদ্ধার
তোমরা কোথায় ছিলে, কোন দেশে ঘর, বলো, কোন জ্ঞাতি
তোমাদের নিকট-আত্মীয়, ব্যাপক হৃদয় জুড়ে কোন
ধ্বনি বেজে ওঠে আজো? তোমাদের পিতা-পিতামহদের
রক্তে ব্রহ্মদেশ কথা কয়, উত্তর-চিনের নদী ভেসে
আসে হৃদয়ের তলদেশে বেয়ে— বুঝি না অস্ট্রিক নাকি
দ্রাবিড়ীয়— অথবা থেকেছো বুঝি পাশাপাশি বহুদিন?
তা হলে ভেঙেছো কেন, ঝরে গেছো কেন প্রিয় মালা, বলো,
কেন তবে ধারণ করোনি বুকে প্রতিবাদ, কেন তবে
অশ্রুর বিরুদ্ধে রাখোনি বারুদ ভরে রেফ্রিজারেটরে?
এসেছিলো মরুভূমি সাথে করে একবার অশ্বারোহী
কোনো, ধ্বংস করে দিয়ে গেছে সবকিছু, আরো দিয়ে গেছে
একশো বছর ভরা নীল অন্ধকার, তোমরা হয়েছো
তারই মৌমাছি, নিয়েছো প্রবহমান বিষ ঠোঁটে তুলে?
ফিরে দেখা
বাতাসে উড়ছে, উড়তে থাকুক জ্যোৎস্নায় ভেজা চুল
রাত্রিপ্রহরে আকাশে ফুটছে লক্ষ তারার ফুল—
এর মাঝখানে একটি সে-গ্রহ-নক্ষত্রের ডালে
ঝুলে আছে দেখে— বজ্রপতনে কেন তুমি চমকালে?
অথচ তোমার সোনালি ফিতেয় বসে আছে নীল পরী
হাওয়াতে দুলছে মিনিটের কাঁটা, কাঁপছে কালের ঘুড়ি।
আমার হৃদয় তারই মাঝখানে উড়ে যায় দূর হ্রদে
সেখানে হাজার নর্তকীদের দেহ ভিজে যায় মদে।
তখন আমার ঢুলু-ঢুলু চোখে রাতের প্লাবন নামে
মাতাল নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি তোমার দেহের ঘামে
মহুয়া-বুকের বিহ্বল টানে করি অপরূপ ভুল
রাতের আরতি শেষ হয়ে গেলে জ্যোৎস্নায় ভেজা চুল
আমাকে জাগায়— একাকী প্রহরে আমি হেঁটে আসি একা
তোমার আলোতে সেই তো নিজেকে বারবার চেয়ে দেখা।
আমার হারানো স্মৃতি ও এক বোবা মেয়ের গল্প
এ-পথ আমার চেনা— শত-সহস্র-লক্ষবার আমার পায়ের চিহ্নে এই পথ হয়েছে
রঞ্জিত। কতো সকাল, কতো দুপুর, আর কতো রাত শিশিরে সিক্ত এই দেহ ছুঁয়ে
গেছে এ-পথের প্রতি ধূলিকণা— প্রতিটি ঘাসের ডগা, তৃণমূল-মৃত্তিকা আর্তনাদ
করে উঠে আমাকে জানিয়ে গেছে, এইখানে একদিন মধুর স্বপ্নের মতো স্নিগ্ধ ছিলে
তুমি। তোমার সম্মুখে যে-দুই বিঘা জমি, পেছনে যে-স্মৃতিময় দুরন্ত পুকুর, তার
পিছনে ননীদের ঘর, একটু সামান্য দূরে কালীবাড়ি, শৈশবের আটচালা, সবেই কি
তেমনি আছে?
কতোদিন আগে আমি সেইসব ফেলে এসে এ-নগরে আশ্রয় নিয়েছি। মনে আছে,
তখনো ভোরের কাক করুণ-কারত স্বরে ডেকে উঠে বলেনি আমাকে, ‘কই যাও,
সোনা দাদাভাই?’ আধো-আলো-অন্ধাকারে শুধু পিছে এসে দাঁড়িয়েছে পাড়ার
স্বজন। যখন চলে আসছি, কূল ছেড়ে আসা নৌকার মতন তাদের অন্তিম দীর্ঘশ্বাস
টান মেরেছে বুকের পাঁজরে। ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছি পিতৃপুরুষের ভিটে,
শকুনি দিঘির জলে রেখে এসেছি বাবা-মার দেহভস্ম— দেখতে পাচ্ছি,
দরগাখোলার কাছে শ্মাশানে পুড়ছে দেহ, দেখতে পাচ্ছি চক্কোত্তির তীক্ষ্ণ চোখ,
মান্নানের ক্ষুধার্ত থাবা— ঝকঝকে ছুরি হাতে প্রতিবেশী শিষ্যের চমৎকার
গুরুদক্ষিণা। আতঙ্কে ও আর্তনাদে কেটে গেছে কতো-শত বিনিদ্র রাত, কেটে
গেছে হাহাকারে বিদীর্ণ সময়। তারপর মৃত্যুর শীতল স্পর্শে হিম হয়ে গেছে সব।
পিতা নেই, মাতা নেই, স্মৃতির জানালা ধরে এখন দাঁড়িয়ে আছে কতোগুলো
অচেনা মানুষ। আমার শৈশব, আমার কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতিগুলো ফেলে
রেখে এখন বসত করি আমি এক অজানা শহরে।
আহা, কতোদিন পরে আমি ফের এখানে এলাম— দেখা হলো মদনের সাথে,
নতুন পথের মাঝে ডাকলো নেপাল, দ্রুতবেগে চলে-যাওয়া রিকশা-আরোহী এক
নেমে এসে পায়ে হাত দিলো, জীর্ণ দোকান থেকে বয়স্ক সালাম এসে শুধালো
কুশল। আমার দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়লো বিন্দু-বিন্দু জল। বিবর্ণ মুখ থেকে বের
হলো নৈঃশব্দের বর্ণমালা, আমার বুকের ভেতরে শত-শত আর্তনাদ অজস্র চিৎকার
হয়ে উগলে পড়লো বালির পুকুরে।
আমি চলে এলাম। হাঁটতে-হাঁটতে আমার প্রাণ-জুড়ানো লেকের পাড়ে চক্কর
দিলাম কয়েকবার। আমার পিতাও রোজ খুব ভোরে এইখানে দুটি পায়ের চিহ্ন
রেখে গেছে অতি সন্তর্পণে। সেই পথে হেঁটে এসে কোর্ট-কাচারির ধারে ছোট্ট এক
আমগাছের ছায়ার নিচে বসে চিরচেনা লেকের জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে
নিজেরই কম্পমান ছায়া দেখে অকস্মাৎ চমকে উঠলাম আমি।
জীবনকাকুর দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে গিয়ে বুকের ভেতরে পাথরের মতো ভারী
এক দীর্ঘশ্বাস স্মৃতিরজালে আটকা পড়ে গেলো।
সবকিছু কেমন বদলে গেছে, মুখর প্রান্তর এক আকস্মিক অগ্নিদহনে যেন
পুড়ে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাজল-শ্যামল আর অনলের বাড়ির সকল কিছু
এখনো তেমনি আছে, শুধু ওরা নেই। কাজল ঢাকায় থাকে, শ্যামল ব্যারাকপুরে,
শুনেছি, অনল নাকি দত্তপুকুরে।
ফিরে আসবার আগে একবার স্মৃতিময় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। অকস্মাৎ
সামনে এসে দাঁড়ালো সেই বোবা মেয়েটি, যার প্রাণের স্পর্শে প্রতিদিন ভরে
উঠতো আমাদের আঙিনার মর্মস্নিগ্ধ মাটি। আমাকে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিয়ে
কান্নায় ভেঙে পড়লো সে— জড়ো হয়ে গেলো চেনা ও অচেনা নারী আর পুরুষের
দল, তাদেরকে হাত নেড়ে বোঝালো সে— চিনতো পেরেছে তার দাদাকে সে
বহুদিন পর। একবার হাত দিয়ে দেখালো সে স্মৃতিময় আমাদের হারানো
বাড়িকে, একবার দেখালো আমাকে— তারপর বুক-ফাটা বোবা কান্না প্রকাশ
করতে না পেরে বলীর পশুর মতো গোঙালো সে। ঘূর্ণিবায়ুর মতো ওর বক্ষবিদীর্ণ
আর্তনাদ আমার বুকের ভেতরে যে-কম্পমান কান্নার উতরোল সৃষ্টি করলো, আমি
তা সইতে না পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। যে-চোখে সহসা কোনোদিন জল
আসেনি, যে-বুকে শত-সহস্র ঝড়ও কোনো কাঁপন তুলতে পারেনি, সেই চোখে
অকস্মাৎে নেমে এলো অঝোর প্লাবন। বোবা মেয়েটির আকুতিলীন গহন হাহাকারে
আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো জমাট-বাঁধা কান্নার রোল— আমি মুখ
ফিরিয়ে নিজেকে অনন্তকালের গর্ভে নিমজ্জিত করার চেষ্টা করলাম। বোবা মেয়েটি
তখন এক নিরেট পাথর।
উদ্বাস্তু
ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো বাচ্চা বুকে করে
বুকের আঁচল উদোম ছিলো— রাত্রি ছিলো ঘোর
লাইনের ধারে ছেইলার বাপে কাবার করে ভোর
ফিরতেছিলো ঘরের দিকে— তখন গেলো সরে
চারটি ছোড়া অন্ধকারে— হাতে ধারালো ছুরি
‘এইশালী, এই ছিনাল মাগী, খোল, দরোজা খোল্’
— বলেই প্রবল ধাক্কা মারে, লাগায় শোরগোল
লাফিয়ে উঠে থমকে দাঁড়ায় বিশ বছরের ছুঁড়ি।
কঁকিয়ে ওঠে বাচ্চা তাহার, জাপটে ধরে : মা-রে!
তখনই চার দস্যু এসে ছিনিয়ে নেয় ছেলে;
ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের ওপর— ইচ্ছে মতন খেলে
শরীরটাকে খুবলে খেয়ে পালায় অন্ধকারে।
ছেইলার বাপে দৌড়ে আসে, দেখে সকল শেষ;
কান্না আসে বুকের ভেতর, জল আসে না চোখে,
এর লিগা কি গাঁও ছাইড়াছে, ছাড়ছে নিজের দেশ?
গাঁও ছাড়িলো, দেশ ছাড়িলো, হায় রে ভগবান!
ভাটির দেশের মাইয়ায় শোনে কোন্ ভাইটালি গান!
স্পর্শ
তোমার শরীরে হাত আকাশ নীলিমা স্পর্শ করে
ভূমণ্ডল ছেয়ে যায় মধ্যরাতে বৃষ্টির মতন
মুহূর্তে মিলায় দুঃখ, দুঃখ আমাকে মিলায়
জলের অতল থেকে জেগে ওঠে মগ্ন চরাচর
দেশ হয় দেশ, নদী হয় পূনর্বার নদী
নৈঃশব্দ্য নিরুণ হাতে করতালি দেয়
নিসর্গ উন্মুক্ত করে সারাদেহে নগ্ন শরীর
কোনখানে রাখি তুলে দেহের বিস্তার
তোমার শরীরে হাত দীর্ঘতর আমার শরীর;
তোমার শরীরে হাত সূর্যোদয়, মেঘে রৌদ্র
জন্মান্তর আমার আবার;
তোমার শরীরে হাত একদিন, এই জন্মে শুধু একবার!
জলছত্র
শহরের চৌদিকে ওরা খুলে দেয় সুবিখ্যাত জলছত্র সব
তবু কানে আসে কলরব
ভীষণ পিপাসা এইখানে, জল চাই
মানুষের পিপাসার জল নাই
মিউনিসিপ্যালিটির এই বড়ো বড়ো ট্যাঙ্কের তলায়
বালি আর কঠিন কাঁকর সব জমে আছে। আমাদের বিশুষ্ক গলায়
একবিন্দু শীতল জলের স্বাদ দিতে পারে এমন প্রকৃত কোনো হ্রদ নেই
কাছে কিংবা যেখানেই
তাকাই কেবল আজ চোখে পড়ে ধোঁয়ার কফিন
সগর আর নদীর জল প্রতিদিন
বাষ্পীয় জাহাজে চড়ে চলে যায় দূরবর্তী চাঁদের শহরে
সেইসব প্রাণশূন্য ঘরে
বসে পৃথিবীর শ্যামল জলের বাজার
থরে থরে গজায় বৃক্ষবাড়ি, লোকালয় এখানে হাজার
মরে পিপাসায়, জল নেই শহরে কোথাও
শহরে কোথাও আজ শান্তি নেই, যদিও অনর্গল শান্তির ডঙ্কা পেটাও
খুলে দাও জলছত্র, তবু হায়
এ শহরে মরে লোক ভয়ে জলশূন্যতায় আর
পিপাসায়।
তুমি যাও
যে প্রশস্ত পথের সন্ধান তুমি পেয়েছো
সেই পথ ধরে তুমি সামনের দিকে এগিয়ে যাও
প্রলয়ের অন্ধকার তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!
শুধু আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিও;
বিভক্ত কাঁচের দুপাশে দুরকমের তুমি
আর নেপথ্যের হা হা অন্ধকারে আমি একা!
তুমি আর একবার বুঝে নাও—
প্রশস্ত পথ ধরে তুমি সামনের দিকে
এগিয়ে যেতে পারবে কিনা?
আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি:
অন্তত আমার প্রলয়ের অন্ধকার
কিছুতেই তোমার পথরোধ করে দাঁড়াবে না!
যদি তুমি পারো তবে যাও—
তুমি যাও!
দৈনিক গণঅধিকার সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।